৪০ লাখ মামলায় মাথাভারী আদালত

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ১০:৫৪ পিএম
  • একাধিক বিচারক একটি এজলাস ভাগাভাগি করে চলছে বিচার কার্যক্রম
  • ২০০৬ সালের প্রকল্প ২৩ জেলায় কাজ শুরুই হয়নি
  • নারী, শিশু ও বৃদ্ধ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ

দেশের আট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ৩৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬১টি। এসব কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।

আদালত সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার জজ কোর্টেই এজলাস ভাগাভাগি করে চলছে বিচার কাজ। টিনশেড ভবনের পাঁচটিতেই এজলাস ভাগাভাগি করতে হয়। টিনশেডের একটি এজলাসে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোর্ট-১১, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৯, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোর্ট ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৮। আরেকটি এজলাসে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোর্ট-১৩, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২১, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোট-১৫ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২৩। 

অপর আরেকটি এজলাসে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোর্ট-১২, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২০, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কোর্ট-১৬ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২৪ এর বিচার কাজ চলছে। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এজলাস সংকটের কারণে সিজিএম ভবনের কয়েকটি ফ্লোর ব্যবহার করতে হচ্ছে। 

রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলা জজ আদালত হওয়া সত্ত্বেও এখনো এজলাস সংকট বিদ্যমান। বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জন্য নির্মিত তিনতলা একটি পুরনো ভবনে চলছে সব আদালতের বিচার কাজ। অবকাঠামোগত সংকটের কারণে এখানে বিচারকরা এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কাজ করেন।

বিচারক সংকট ও এজলাসের অপ্রতুলতাকে মামলা জটের প্রধান কারণ বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। এখনো ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলা জজ আদালতে এজলাস ভাগাভাগি করে চলে বিচারকাজ। সারা দেশের ১৩০ জন বিচারক এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ পরিচালনা করার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে জেলা জজ আদালতের ৬৬ জন বিচারক এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৬৪ জন বিচারক এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কাজ করেন।  

এ বিষয়ে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, গত ১৫-২০ বছর ধরে দেশের জেলা আদালতের বিচারকরা এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকাজ পরিচালনা করে আসছেন। ফলে একজন বিচারক দিনের পূর্ণ সময় বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারছেন না। এ কারণেও মামলা জট বাড়ছে। 

তরুণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জানোকী জানান, আমাদের সিনিয়ররা অর্থঋণ আদালতগুলো সব একই ভবনে দেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু জানানো হয় নতুন এজলাস খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

সম্প্রতি জেলা জজ কোর্টের নতুন ভবনের একটি এজলাসে অর্থঋণ আদালত-৫ ও অর্থঋণ আদালত-৬ নির্ধারণ করা হয়েছে। এখনো সেরেস্তাদারের  কোনো রুম বরাদ্দ হয়নি।

স্বয়ং গাজীপুরে দায়রা জজ এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে আইনজীবীরা জানান। দুপুর ২টা পর্যন্ত বিচার কাজ করার পর ওই কোর্টে বিচার কাজের জন্য বসেন অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ। এভাবে গাজীপুরের প্রায় সাত থেকে আটজন বিচারক এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কাজ করেন।

এ ছাড়া মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারকরা বসছেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পাশে করা টিনশেড ভবনে। ফলে বিচার কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরাও। 

এ বিষয়ে গাজীপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জাকিরুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন হলেও এখনো রাজধানীর কাছের শহর গাজীপুরে ভবন নির্মাণ হয়নি। ২০২২ সালের শেষদিকে ভবনের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্তই। এজলাস সংকটের কারণে সাত-আটজন বিচারক পূর্ণ সময় বিচার কাজ পরিচালনা করতে পারছেন না। এজলাস ভাগাভাগি করতে হয় তাদের। স্বয়ং মহানগর দায়রা জজ এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কাজ করেন।

তিনি বলেন, গাজীপুরে একটি মাত্র নারী ও শিশু আদালত। যার ফলে ওই আদালতে এখনো আট হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। 

সূত্র জানায়, এজলাস সংকট কাটাতে ২০০৬ সালে ৬৪ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্প হাতে নেয়ার পর গত ১৬ বছরে ৪১টি জেলায় এই ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৩ জেলায় এখনো ভবনের কাজ শুরুই হয়নি। আর এসব ধীরগতির পেছনে পতিত সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রকল্পের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহাকে দায়ী করছেন আইন সংশ্লিষ্টরা। তাদের গাফিলতির কারণে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

ভবন না হওয়া ২৩ জেলা হলো- গাজীপুর, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, চাঁদপুর, নওগাঁ, নাটোর, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, মেহেরপুর, বরগুনা, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, শেরপুর ও নেত্রকোনা।

বরগুনা জেলা জজ আদালতে এখনো সিজিএম ভবন হয়নি। বরগুনায় প্রায় ৩৫ হাজার মামলা বিচারাধীন। কক্ষ সংকটের কারণে একই এজলাস দুইজন বিচারক পালাক্রমে ব্যবহার করেন। এতে বাড়ছে মামলার দীর্ঘসূত্রতা।

আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনায় শুধু এজলাস সংকটই নয়, বিচারপ্রার্থীদের জন্য নেই কোনো বিশ্রামাগার। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি মানুষ আদালত সংশ্লিষ্ট কাজে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বসার জায়গা না থাকায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা খোলা মাঠ বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন। আদালতের বারান্দায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। এতে নারী বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে শিশুরা থাকায় চরম বিপাকে পড়েন তারা। অন্যদিকে স্থান সংকটের কারণে একটি এজলাসের মধ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম সারছেন আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। 

বরগুনার আইনজীবীরা জানান, বরগুনার জেলা জজ আদালতে তৎকালীন সরকারের সময় সিজিএম ভবন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তৎকালীন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ভবনের পাশে আদালতের জায়গাতেই ভবন করতে গেলে বাধা দেন ডিসি। একইভাবে অন্যপাশে করতে গেলে বাধা দেন তৎকালীন এসপি। 

এ বিষয়ে ওই আদালতের আইনজীবী মো. জামাল হোসেন বলেন, আদালতের জমিতে ভবন করতে গিয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও এসপির বাধার সম্মুখীনের কারণে সিজিএম ভবন হয়নি।