সনদ ঘিরে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ১২:০৪ এএম

দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ‘জুলাই সনদ’। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত এই দলিল একদিকে যেমন উদ্দীপনা ও আশাবাদের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক, সংশয় আর তীব্র মতপার্থক্য। 

মূলত সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই দলিলটি উপস্থাপন করা হয়। এতে ভবিষ্যতের নির্বাচন, সংবিধান সংশোধন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এই সনদের প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনের মূলধারার দলগুলো থেকে শুরু করে ইসলামি ও বাম ঘরানার জোট পর্যন্ত কেউই নির্লিপ্ত থাকেনি। কেউ একে দেখছেন নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা হিসেবে, আবার কেউ বলছেন এটি একটি ‘মুঠি-চাপা ষড়যন্ত্র’। 

যদিও ‘গণতন্ত্রের পথে সাহসী অগ্রগতি’ আখ্যা দিয়ে সবচেয়ে জোরালোভাবে জুলাই সনদকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সনদ এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের অঙ্গীকার রয়েছে, যা আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। 

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি পরীক্ষার সময়। বিএনপি বিশ্বাস করে, এই দলিল বাস্তবায়িত হলে সহিংসতা ও একচেটিয়া রাজনীতির অবসান ঘটবে। 

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জুলাই ঘোষণাপত্রকে ‘অপূর্ণাঙ্গ’ ও ‘প্রত্যাশা-বিচ্যুত’ দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। দলটির মতে, এই সনদে গণমানুষের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি।

দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মু. তাহের বলেন, জুলাই সনদে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে নিহতদের ঘটনা, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক-ছাত্র, প্রবাসী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ভূমিকার কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ৯ দফা আন্দোলনের এক দফায় রূপান্তর, ৬টি কমিশন গঠন এবং ১৯ দফা ঐকমত্যের কোনো স্পষ্ট বিবরণও ঘোষণাপত্রে নেই। এছাড়া ঘোষণাপত্রে বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা ও পদ্ধতি না থাকায় একে ‘গুরুত্বহীন’ বলে দাবি করেছে জামায়াত। এরপরও ‘জাতীয় স্বার্থে’ প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে তারা ‘ইতিবাচকভাবে’ দেখছেন বলেও জানান তিনি। 

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিক্রিয়ায় উঠে এসেছে জুলাই ঘোষণাপত্রটি পরিপূর্ণ হয়নি। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, এতে কিছু অগ্রগতি থাকলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে, যা এই দলিলকে অসম্পূর্ণ করেছে। তারপরও গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার ‘দৃশ্যমান’ করার দাবি জানিয়েছে তারা। 

জুলাই সনদের সমালোচনা করে আখতার হোসেন বলেন, ঘোষণাপত্রে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা বলা হয়েছে ‘প্রায় এক হাজার’, অথচ জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে ১৪০০ শহীদ। এক বছরেও সরকার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে ব্যর্থ। ৪৭-এর আন্দোলন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর, কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আবরার হত্যা ও মোদিবিরোধী আন্দোলনের তথ্যও উল্লেখ নেই। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, পরবর্তী সরকার এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন করবে। এভাবে নতুন সংবিধানের দাবি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, এনসিপি চায় অন্তর্বর্তীকালীন বাস্তবায়ন। অর্থাৎ সংস্কারের বাস্তবায়ন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার থেকেই শুরু করতে হবে। শুধু ভবিষ্যতের সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। আর প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেও তাতে আপত্তি নেই এনসিপির। 

জুলাই সনদকে সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক দেখছে বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো। জুনায়েদ সাকিসহ বাম জোটের নেতারা বলছেন, যারা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, তাদের চূড়ান্ত চাওয়া ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান। সনদে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি থাকায় আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা সতর্ক করে বলছেন, শুধু প্রতিশ্রুতি দিলে চলবে না, বাস্তবায়নে প্রকৃত রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। 

জুলাই সনদ নিয়ে ‘আস্থা কম, সংশয় বেশি’ বলছে ইসলামী দলগুলো। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো এই সনদ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। 

ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম বলেন, ইসলামী মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে কোনো রূপরেখা দিলে সেটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই সনদে রাষ্ট্রের ইসলামি পরিচয়ের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তারা মনে করেন, জাতীয় সংকট নিরসনে একটি ধর্ম-সমন্বয়ভিত্তিক পথরেখা দরকার ছিল। 

খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্র, ঘোষণার পুরো আয়োজন এবং মাত্র একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ— সবকিছুই প্রমাণ করে, ইসলামপন্থি শক্তির মতামত, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ভূমিকাকে পরিকল্পিতভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবহেলার শামিল। 

তিনি আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়েছেন— আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, সরকার একটি পক্ষের ইতিহাসকেই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। 

গণঅধিকার পরিষদ বলছে, মিথ্যা ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে নির্মিত হয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্র। দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলছেন, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট গঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে কোটা ফিরে না এলে এই আন্দোলন হতো না। অথচ সেই আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসকে চকচকে ব্যাখ্যার পেছনে আড়াল করে দেয়া হয়েছে, যা ইতিহাস বিকৃতির শামিল। ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গণঅধিকার পরিষদ ও ছাত্র অধিকার পরিষদের লড়াই-সংগ্রামকে ঘোষণা থেকে বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ৭১-এর ইতিহাসে। তাহলে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিহাস নির্মাণে পার্থক্য কোথায়? জুলাই সনদ ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায় নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দ্বিধা-বিভক্ত বাস্তবতা। 

নাগরিক সমাজের অনেকে এই সনদকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও তারা বলছেন, কথা আর কাজে ব্যবধান থাকলে এটি ভবিষ্যতে আরও বিভাজনের জন্ম দিতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্র যদি এই ঘোষণা বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়, তবে এটি হবে রাজনৈতিক সংস্কারের একটি মাইলফলক। তবে এই সনদ এক ধরনের দ্বৈত বাস্তবতা তৈরি করেছে— একদিকে মানুষ আশা দেখছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ছে।