ভেস্তে যাচ্ছে সমলয় চাষাবাদ

নওগাঁ প্রতিনিধি প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৩, ০১:২৯ পিএম
ভেস্তে যাচ্ছে সমলয় চাষাবাদ

সংশ্লিষ্ট কৃষকদের অজ্ঞতা, অবহেলা আর অনিয়মের কারণে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় ভেস্তে যাচ্ছে কৃষি বিভাগের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় সমবায় ভিত্তিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সমলয় চাষাবাদ। 

অনিয়মের কারণে এখানে দুধরনের ধানের চারা রোপণ করায় এক জাতের আগে অন্য জাতের ধান পেকে যাওয়ায় সেগুলো আগেই কাটা শুরু হয়েছে। 

যন্ত্রের পরিবর্তে চাষিরা এগুলো কাটছেন নিজ হাতে কাস্তে নিয়ে। ফলে যান্ত্রিকীকরণের মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হয়েছে। গচ্চা যেতে বসেছে এই প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দ করা মোটা অংকের টাকা। কর্র্তৃপক্ষ বলছেন আগেই ধান পাকা ও কাটার বিষয়ে কৃষকরা তাদেরকে কিছু জানাননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বোরো মওসুমে ধানকাটার সময় ফিবছর কৃষি শ্রমিকের সংকটে সময়মত ধান কাটতে না পারায় চাষিদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। সময়মত ধান কাটতে না পারায় প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে মাঠেই বিনষ্ট হয় কৃষকের শ্রম ঘামে ফলানো সোনালী ফসল। 

এ অবস্থার নিরসনে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতির নাম সমবায় ভিত্তিক সমলয় চাষাবাদ Synchroniæe Cultivation. যেখানে একটি মাঠে বা মাঠের একটি অংশের সকল কৃষক একসঙ্গে একই জাতের ধান একই সময়ে যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণ করবেন। 

এ পদ্ধতিতে বীজতলা থেকে চারা তোলা, চারা রোপণ ও ধানকর্তন সব প্রক্রিয়া যন্ত্রের সাহায্যে সমসময়ে সম্পাদন করা হবে। সমলয়ে ধান আবাদ করতে হলে চারা তৈরি করতে হবে ট্রেতে। ট্রেতে চারা উৎপাদনে জমির অপচয় কম হয়। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে চারা একই গভীরতায় সমানভাবে লাগানো হয়। 

কৃষক তার ফসল একত্রে মাঠ থেকে ঘরে তুলতে পারেন। কারণ একসঙ্গে রোপণ করায় সব ধান পাকবেও একই সময়ে। তখন ধান কাটার মেশিন দিয়ে একই সঙ্গে সব ধান কর্তন ও মাড়াই করা হবে। এসব কারণে সমলয় পদ্ধতিতে যন্ত্রের ব্যবহার সহজতর ও বৃদ্ধি হবে। ধান চাষে সময়, শ্রম ও খরচ কম লাগবে। এ ক্ষেত্রে কৃষক লাভবান হবেন এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ পদ্ধতির প্রবর্তন সহজ হবে। 

চলতি বোরো মওসুমে সরকার দেশের ৬১ জেলায় মোট ১১০ টি সমলয় চাষাবাদের প্রদর্শনী স্থাপনের জন্য মোট ১৫ কোটি ৭ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে। এর মধ্যে মহাদেবপুর উপজেলায় বরাদ্দ করা হয় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৫শ’ টাকা। উপজেলার সদর ইউনিয়নের বকাপুর মাঠে ৫০ জন চাষির ৫০ একর জমি নিয়ে তৈরি করা হয় এই প্রদর্শনী খেত। নিয়মানুযায়ী একর প্রতি ২ কেজি করে হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ কিনে ট্রে তৈরি করে সেখানে বীজ বপণ করা হয়। তবে নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করায় অর্ধেক চারা নষ্ট হয়। ফলে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে প্রদর্শনীর অর্ধেক খেতে রোপণ করতেই চারাগুলো শেষ হয়ে যায়। 

চাষিদের দলনেতা বকাপুর গ্রামের চাষি মো. মিঠু, সদস্য চাষি আবু হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, মেছের আলী, জহুরুল হক, আব্দুল হামিদ, সুনিল কুমার, ভোলা প্রমুখ অভিযোগ করেন যে, বাকী অর্ধেক জমির মালিকেরা নিজের টাকায় স্থানীয় জাতের ধানের চারা কিনে নিজেরাই রোপণ করেন। 

বীজ কেনার জন্য একরপ্রতি ১ হাজার ৫৬০ টাকা, বীজতলা তৈরির জন্য ২ হাজার টাকা, বীজতলার পরিচর্যার জন্য ২ হাজার টাকা, আর রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে রোপণের জন্য ৩ হাজার টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও তাদেরকে তা দেয়া হয়নি। 

সরকারি টাকায় কেনা সার বিতরণে তালিকা মানা হয়নি। ৫০ জন কৃষকের অনেকেই সার পাননি। এখানে কৃষি বিভাগের সার্বক্ষণিক সহযোগীতার মাধ্যমে সেক্স ফরোমন ফাঁদ ব্যবহার, লাইভ পার্চিং, আলোক ফাঁদ, জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার, জৈব সার ব্যবহার কোনটিই হয়নি। 

ফলে ধানে আক্রমণ হয়েছে একের পর এক পোকার। বাজার থেকে একের পর এক জাতের কীটনাশক কিনে প্রয়োগ করেছেন কৃষক। তবে পোকার আক্রমণ ঠেকাতে পারেননি পুরোপুরি। পুরো খেতের স্থানে স্থানে পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়েছে ধানের শীষ। প্রদর্শনীতে কীটনাশক প্রয়োগের জন্য কোন বরাদ্দ রাখা না হলেও চাষিদের নিজ তহবিল থেকে একরপ্রতি ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়েছে। 

কৃষি বিভাগের তৈরি বীজতলা থেকে রোপণ করা হাইব্রিড জাতের ধানের চেয়ে অনেক আগেই কৃষকদের কেনা স্থানীয় জাতের অর্ধেক জমির ধান পেকে যায়। তবে কৃষি অফিসের কেউ যোগাযোগ না করায় গত সপ্তাহে চাষীরা নিজেরাই সেসব জমির ধান কেটে আনা শুরু করেন। ফসল কাটার জন্য একরপ্রতি ৪ হাজার ৫শ’ টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। 

চাষিরা বলছেন, এরআগে তারা হাইব্রিড জাতের ধানের চাষ করেননি। ফলে এটি চাষে একরকম শঙ্কা রয়েই গেছে। তার উপর সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতায় চারা সংকট দেখা দিয়েছে। জৈব বালাই নাশক পদ্ধতিও তাদেরকে ভাল করে শেখানো হয়নি। হাইব্রিড ধানে কোন কোম্পানীর কোন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে সে পরামর্শও তাদেরকে দেয়া হয়নি। এমনকি ধান কি রকম হবে, তা বাজারে বিক্রি হবে কিনা, কি রকম দাম হবে, তা নিয়েও তাদের শঙ্কা রয়েছে।

প্রদর্শনী খেতের সাইনবোর্ডে এটি দেখভালের দায়িত্ব দেয়া আছে উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মকিম উদ্দিন দেওয়ানকে। তবে মওসুমজুড়ে তাকে কৃষকরা দেখতে পাননি। জানতে চাইলে মকিম উদ্দিন জানান, তিনি অসুস্থ্য ছিলেন। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোমরেজ আলী জানান, কুয়াশায় ট্রেতে তৈরি করা বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাকী জমির চারা একই জাতের না হওয়ায় এবং তা রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে রোপণ না করায় প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্যই ব্যাহত হচ্ছে কিনা তা তিনি জানাতে পারেননি। বরং মাঠের ধান পেকে গেলে চাষিরা সে খবর কৃষি কর্মকর্তাকে না জানিয়ে সাংবাদিকদেরকে কেন জানালেন তা নিয়ে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন। প্রকল্পে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও তিনি জানান।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদও অর্ধেক জমির ধান আগেই পেকে যাওয়ার কথা জানেন না বলে জানান। তাকে জানানো হলে সেগুলোও যন্ত্র দিয়ে কেটে দিতেন। প্রদর্শনী খেতে কীটনাশক প্রয়োগের জন্য কোন বরাদ্দ নেই বলে সে ব্যাপারে তাদের কিছুই করার ছিলনা। তবে ফলন বিপর্যয় হবেনা বলে তিনি দাবি করেন।

এইচআর