ইতিহাস মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, তাড়িত করে। প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কালের বিবর্তনে রূপান্তরিত হয় ইতিহাসে। তেমনি করে `জ্ঞানই শক্তি` নীতিবাক্যকে সামনে রেখে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালের কর্ণকাঠী গ্রামে ৫০ একরের বিস্তৃত সবুজ ভূমিতে স্থাপিত হয় দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠবিদ্যাপীঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজ গৌরবের সাথে ১৩তম বছর পেরিয়ে ১৪তম বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ইতিমধ্যে হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাথে জড়িয়ে আছে নানা জানা-অজানা ইতিহাসের মুহূর্ত। যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চলুন একনজরে তা জেনে আসা যাক।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে সেই দাবি গণদাবিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি বরিশালের বেল’স পার্কের এক বিশাল জনসভায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তার ঘোষণা অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে পরবর্তী যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হবে সেটি হবে বরিশালে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ থমকে দাঁড়ায়।
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ২৩ নভেম্বর বরিশাল সার্কিট হাউজে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার মর্মান্তিক মৃত্যুতেও এ উদ্যোগ আরো একবার থেমে যায়।
এরপর ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার পৃথক বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠা করলে, নতুন বিভাগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। সেসময়, ব্রজমোহন কলেজের উচ্চমাধ্যমিক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। কিন্তু বরাবরই বাস্তবায়নের অভাবে বরিশালের মানুষের আশা আবার ভঙ্গ হয়।
নব্বইয়ের দশকের শেষে আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা সদরগুলোতে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০০০ সালে “বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠার প্রকল্প অনুমোদন পায়।
২০০১ সালের ১৫ জুলাই বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হলে এতে বলা হয়, বৃহত্তর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নে `বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়` (Barisal Science and Technology University) নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পূর্বে অনুমোদিত প্রকল্পের অধীনে পটুয়াখালীতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। কিন্তু বরিশালের প্রকল্পটি বাতিল করে পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এসময় আবারো ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার তোড়জোড় শুরু হয়। তবে, বরিশালবাসীর একাংশের দাবি ছিল স্বতন্ত্র পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের, ব্রজমোহন কলেজের ঐতিহ্য নষ্ট করে নয়।
পরবর্তীতে তৎকালীন বরিশাল-৫ আসনের বিএনপি সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় গৃহীত প্রকল্পের স্মরণে ‘শহিদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৬ সালের ‘শহিদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ প্রণয়ন করে। একই বছর বিএনপি সরকার বরিশাল শহরের সন্নিকটে কড়াপুরে নবগ্রাম রোডের পাশে ডেফুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্ধারণ করে ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে সেই প্রচেষ্টা আর এগোয়নি।
পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জোরালো হয়। ২৯ নভেম্বর ২০০৮ সালে তৎকালীন ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব একনেকে পাস করে, কিন্তু অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা আর সম্ভব হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আমলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ পুনরায় শুরু হয়। ঐ বছর ২৮ মার্চ একনেক সভায় পুনরায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৯৫ কোটি টাকা। ৯ অক্টোবর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরিশাল সফরে এসে মৌখিকভাবে সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের কর্ণকাঠি গ্রামে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান পরিদর্শন ও নির্ধারণ করেন। কর্নকাঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নির্ধারণ এবং জমি অধিগ্রহণে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন ও “শহিদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়” এর পরিবর্তে “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়” নামকরণের প্রস্তাব করেন।
২০১০ সালের ১৬ জুন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংশোধিত আইন পাস হয় ও পরবর্তী সময়ে প্রাথমিকভাবে বরিশাল জিলা স্কুলের পরিত্যক্ত কলেজ ভবনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য বরিশাল শহরের সন্নিকটে কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব তীরে নির্মাণাধীন দপদপিয়া সেতুর কাছে কর্ণকাঠী গ্রামের ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সফরে এসে দেশের ৩৩তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়” এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরপর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. মো. হারুনর রশীদ খানকে ৪ বছরের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। শিক্ষা কার্যক্রম ও ভর্তি শুরু হতে লেগে যায় আরো এক বছর। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ৪টি অনুষদের ৬টি বিভাগের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৬টি বিভাগে ৪০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের অধীনে ২৫টি বিভাগে প্রায় ৯৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৪টি (২ টি ছাত্র ও ২টি ছাত্রী) আবাসিক হল রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ২১০জন, খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন ৬জন। এর প্রশাসনিক অফিস সংখ্যা ২৩টি, কর্মকর্তার সংখ্যা ১২১ জন এবং কর্মচারীর সংখ্যা ১৫২জন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা-গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। উচ্চশিক্ষার জন্য চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ ইউরোপের দেশগুলো থেকে স্কলারশিপ পেয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চাকরির বাজারেও নেই পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ গ্রাজুয়েটরা বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতায় বরিশাল অঞ্চলের রয়েছে সমুন্নত ঐতিহ্য। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চলের অতীত মহিমাকে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এআরএস