‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি দিবস’ উপলক্ষে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার শহিদ পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় ও স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) প্রশাসন।
রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে ‘জুলাই বিপ্লব প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি’র উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এ সময় ১৭টি শহিদ পরিবারকে উপহার এবং বিপ্লবে গ্রেফতার হওয়া ৩১ জন শিক্ষার্থীকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান। প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র উপদেষ্টা ও কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, “২০২৪ সালের ২৪ জুলাইয়ের আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ১৬ জন এবং ঝিনাইদহে ১৩ জন শহিদ হন। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আমরা গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও স্পিরিট ধারণের সুযোগ পাচ্ছি।”
ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ.বি.এম. সিদ্দিকুর রহমান আশরাফী বলেন, “শহিদ পরিবারের প্রতি সম্মান রেখে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।”
ইবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মতিনুর রহমান বলেন, “অনেকে এই সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলেন, আমি বলি এটি একটি মাফিয়া সরকার। ৪ তারিখ আমরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার পর আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। সরকার পতন না হলে শুধু চাকরি নয়, জীবনও অনিশ্চিত ছিল।”
বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন ইউট্যাব-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. তোজাম্মেল হোসেন বলেন, “শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে অংশ নেওয়ায় ২৮ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিল। শহিদ পরিবারকে সম্মান জানাতে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
কারাবরণকারী শিক্ষার্থী জাকারিয়া হোসেন (শিবির কর্মী) স্মৃতিচারণ করে বলেন, “সেদিন কুষ্টিয়ায় আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলে শাখা শিবিরের সভাপতি আবু মুসা ভাই আমাদের নির্দেশ দেন—একজন কর্মীও পিছু হটবে না।”
প্রথম গ্রেফতার হওয়া শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান (ইইই বিভাগ, ২০১৭-১৮) বলেন, “আমি ৭১ দেখিনি, কিন্তু ২৪ জুলাই দেখেছি। যারা শহিদ হয়েছেন বা পঙ্গু হয়েছেন, তাদের তুলনায় আমি নগণ্য। সেদিন পুলিশ মোবাইল কেড়ে নিয়ে হাজতে নেয়, খাবার ও পানি দেয়নি। আমাদের শিক্ষকরা চেষ্টা করে আমাকে ছাড়া পেয়েছিল।”
শহিদ বাবলু ফরাজের সন্তান সুজন মাহমুদ ফরাজ বলেন, “সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে গুম-খুন-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।”
শহিদ ইউসুফের মেয়ে শিমা খাতুন বলেন, “আন্দোলনে আমিও অংশ নিই। গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন আব্বা মারা যান, তখন পায়ের দিকে তাকিয়ে তাঁকে শনাক্ত করি। সেই দৃশ্য আজও ভুলিনি।”
শহিদ সবুজের স্ত্রী রেশমা খাতুন বলেন, “আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তাঁর নামে মামলা করেছি, ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি। আমি সুবিচার চাই, খুনিদের ফাঁসি চাই।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবি শাখার সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, “শহিদদের স্বজনদের আর্তনাদ শুনে প্রশাসন যেন যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা যেন বিভাজনের ষড়যন্ত্রে না জড়াই, জুলাইয়ের স্পিরিট যেন হারিয়ে না যায়।”
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, “এটি শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং সেই বিপ্লবী দিনগুলোকে স্মরণ করার আয়োজন।”
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এয়াকুব আলী বলেন, “এই আন্দোলনে আমি অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু এটাকে নিজের কৃতিত্ব বলি না। ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানো আমাদের দায়িত্ব ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও বিপ্লবের পূর্ণতা আসেনি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “রক্তের বিনিময়ে পরিবর্তন আসে। ঐক্যবদ্ধ জাতি ছাড়া ফ্যাসিস্ট শাসন উৎখাত সম্ভব নয়। শহিদদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়—এই প্রত্যয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শহিদদের রক্তের ঋণ কোনো ব্যক্তি বা দল পরিশোধ করতে পারে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার নাম শহিদদের নামে রাখছি এবং ভবিষ্যতেও তাদের স্মরণে নামকরণ করা হবে। তাঁদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা আজ এখানে। এখন আমাদের দায়িত্ব—এই রক্তের ঋণ শোধ করা এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা।”
ইএইচ