ভাইরাল ছবি এবং তারেক রহমান: নেতৃত্ব ও মানবতার এক নিঃশব্দ প্রতীক

শাহেদ শফিক প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ০১:১১ পিএম
ভাইরাল ছবি এবং তারেক রহমান: নেতৃত্ব ও মানবতার এক নিঃশব্দ প্রতীক

কিছু দিন আগে আমি নিজেই লন্ডনের একটি বাংলাদেশি সামাজিক সংগঠনের ‘চ্যারিটি শপে’ যাই। একজন সাংবাদিক হিসেবে তাদের কার্যক্রম দেখার জন্য। যেখানে অপেক্ষাকৃত কম দামে অনেক দামি ও ভালো মানের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ব্রিটেনের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন জামাকাপড় কিংবা বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে এই শপগুলোতে দান করেন। অনেকেই আবার তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রও দান করেন এই শপগুলোতে।

শপের এক কোনায় হঠাৎ করে চোখ আটকে গেলো। যেখানে বেশ কয়েকটি সুন্দর শার্ট ও প্যান্ট ঝুলছে। অধিকাংশই দেখতে নতুনের মতো, কিন্তু ব্যবহৃত। কৌতূহলবশত একটি প্যান্ট হাত দিয়ে ভালোভাবে দেখতে থাকি। তাতে দেখলাম প্যান্টের কোমরে স্ট্যাপলার দিয়ে আটকানো সাদা কাগজে ইংরেজিতে লেখা ‘তারেক রহমান’। দেখে বুঝাগেলো লন্ড্রি দোকান থেকে পোশাকগুলো সদ্য এসেছে। মনে কৌতূহল জমলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের চেয়ারম্যান থেকে এই তারেক রহমান সম্পর্কে জানতে চাই। সঙ্গে পোশাকের দামও।

তিনি প্রথমে জানাতে না চাইলেও পরে নিশ্চিত করে এই তারেক রহমানই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

তিনি প্রায়ই তার ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত পোষাক তাদের চ্যারেটি শপে দান করে থাকেন। তবে দান করার আগে প্রতিটি পোষাক ভালোমানের লন্ড্রি দোকান থেকে ধুয়ে এবং ইস্ত্রি করে দিয়ে থাকেন। ওই পোষাকগুলোও লন্ড্রি দোকানে ইস্ত্রি করার পর সেখান থেকে তাদের শপে দান করেন। যে কারণে লন্ড্রি দোকানের সেই চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।

তার বক্তব্য অনুযায়ী, তারেক রহমান নিজের ব্যবহৃত অতিরিক্ত কিংবা উপহার পাওয়া পোশাকগুলোও ব্যবহার শেষে ভালোভাবে ধুয়ে, পরিচ্ছন্ন করে স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর চ্যারিটি শপে দান করেন, যাতে গরিব-অসহায় মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে এগুলো কিনে নিতে পারেন। সুদূর প্রবাসে থেকেও দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তিনি দেশের মাটিতেও নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক রহমানের ভাইরাল হওয়া কিছু ছবি আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ কী হওয়া উচিত। 

ছবিগুলোতে দেখা যায়, তারেক রহমান লন্ডনের গণপরিবহন ব্যবহার করে কোথাও যাচ্ছেন। তার সঙ্গে কোনো প্রটোকল নেই, নেই কোনো দেহরক্ষীর ঘেরাটোপ। নেই কোনো দামি গাড়ির ঝাঁপটানিও। তিনি এক সাধারণ যাত্রীর মতো বাসে ভ্রমণ করে কোথাও যাচ্ছেন। যদিও একই ধরনের ছবি এর আগেও একাধিকবার ভাইরাল হয়েছে। ছবিগুলো তার অজান্তেই কেউ একজন ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।

রাজনীতির মঞ্চে মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য ভেসে আসে, যা মানুষকে নাড়া দেয়, ভাবতে বাধ্য করে—নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিত। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই ছবিগুলো তেমনই একটি দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন নেতাদের ‘ভিআইপি সংস্কৃতি’ দিনকে দিন সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, তখন তারেক রহমানের এমন সাধারণ জীবনযাপন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। কিন্তু তার এই সরলতা কেবল গণপরিবহনে যাতায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর গভীরে রয়েছে আরও মানবিকতা, আরও আত্মসংযমের দৃষ্টান্ত।

একজন প্রকৃত নেতা কেবল মঞ্চে গলাবাজি কিংবা অর্থ কামানোর ধান্দায় থাকেন না, তিনি মানুষের জীবনের অংশ হয়ে ওঠেন। তারেক রহমানের জীবনধারার দিকে তাকালে আমরা দেখি, তিনি প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেও নীরবে পালন করে চলেছেন তার সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব। তার গণপরিবহন ব্যবহার, সাধারণ বাসায় বসবাস, নিজের হাতে চা বানানো কিংবা বাজার করা—সবই প্রমাণ করে, তিনি রাজনীতিকে দেখেন ‘মানুষের জন্য কাজ করার জায়গা’ হিসেবে, প্রভাব বিস্তারের জায়গা হিসেবে নয়।

তারেক রহমান থেকে আমরা এমন আচরণ আশা করতেই পারি। কারণ তিনি এসব তার পারিবারিকভাবেই শিখেছেন। সমাজ বিজ্ঞান বলছে, মানুষের এমন কিছু আচরণ রয়েছে যা তারা কেবল পরিবারিক ভাবেই শেখে। তারেক রহমান সেই শিক্ষায়ও শিক্ষিত হয়েছেন। আমাদের এও মনে রাখা উচিত তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার সহধর্মিণী সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি নামেও যাদের জীবনে একটি অধ্যায় রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে তার পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা, মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ বা উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা অথবা ভারতের মহাত্মা গান্ধীর মতো নেতারা ঠিক এই পথেই হেঁটেছেন। 

তারা দেখিয়েছেন, নেতৃত্ব মানে ক্ষমতা নয়, দায়বদ্ধতা। তারেক রহমানের জীবনযাপন সেই পথেরই সমান্তরাল একটি ধারা। যেখানে লোক দেখানো কোনো কিছু নেই, আছে অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ।

তারেক রহমানের এই জীবনচর্চা তরুণদের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা হতে পারে। একটি প্রজন্ম, যারা রাজনীতির প্রতি নিরুৎসাহী হয়ে পড়ছে—তাদেরকে বুঝতে হবে, রাজনীতি মানে কেবল উচ্চবিত্ত শ্রেণির বিলাসিতা নয়, বরং এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অপার সম্ভাবনা। 

যখন একজন নেতা তার ব্যবহৃত জামাকাপড়ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দান করে দেন এবং গণপরিবহনের মতো সাধারণ বাসে চলা ফেরা করতে পারেন, তখন তরুণদের মধ্যেও জন্ম নিতে পারে দায়িত্ববোধ ও নিষ্ঠা।

একজন রাজনীতিক যদি নিজের জীবনকে সাধারণ মানুষের জীবনের কাছাকাছি নিয়ে না যান, তাহলে তাঁর বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি কখনই বাস্তব হয়ে ওঠে না। গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা তিনি কতটুকু অনুভব করতে পারেন, সেটি নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত জীবনধারার ওপর। তারেক রহমানের গণপরিবহন ব্যবহার সেই মানবিক সংযোগেরই প্রতিচ্ছবি।

রাজনীতি শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি নয়, এটি একটি আদর্শিক লড়াই, একটি সমাজ গঠনের চেষ্টা। যেখানে নেতা জনগণের মতোই জীবন যাপন করেন, সেখানেই গণতন্ত্রের শিকড় মজবুত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি এখন যেভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে, সেখানে এমন একটি বার্তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

তারেক রহমানের সাদামাটা জীবনযাপন, চ্যারিটিতে পোশাক দান, গণপরিবহনে চলাফেরা—এসব শুধুই বাহ্যিক দৃশ্য নয়, বরং একটি গভীর রাজনৈতিক বার্তা। এই বার্তাটি হলো—নেতৃত্ব মানে জনসম্পৃক্ততা, আত্মত্যাগ ও মানবিকতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন বিভেদ, বিলাসিতা ও প্রটোকলের প্রতিযোগিতা চলে, তখন একজন শীর্ষ নেতার এই নীরব জীবনধারা আমাদের নতুন করে ভাবায়—হয়তো আমরা ভুলে যাচ্ছি রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য।

যদি আমাদের রাজনীতিকরা তারেক রহমানের মতো জীবনচর্চা অনুসরণ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে, গণতন্ত্র মজবুত হবে এবং রাজনীতি হবে সত্যিকারের সেবামূলক কর্মযজ্ঞ। রাজনীতিকে মানবিক করার এই পথচলা যদি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখি, তবে নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এমন একটি দৃশ্য—একজন শীর্ষ নেতা গণপরিবহনে যাত্রা করছেন—নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। এটি কেবল ছবি নয়, একটি বার্তা; একটি দর্শন। তারেক রহমানের এই সাদামাটা জীবনযাপন রাজনীতিতে শুদ্ধতা ও সরলতার যে পথটি অনেকদিন ধরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

ইএইচ