রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি

রায়হান উদ্দিন তন্ময় প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২২, ১২:৫৫ এএম
রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি

হঠাৎ বৃষ্টিতে বাড়ছে মশার উপদ্রব। বৃষ্টির মওসুম শুরুর আগেই রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। কারণ বর্ষা শুরু হলেই এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যায়। রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকিটা বেশি থাকার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বাসা-বাড়ি, শিক্ষা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে মশার কামড় থেকে কেউই রক্ষা পাচ্ছেন না। 

এদিকে বস্তি, আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক এলাকা— সবখানেই মিলছে এডিস মশার লার্ভা। ফলে মশার জ্বালায় শিশু থেকে বৃদ্ধরাও অতিষ্ঠ। মশা প্রতিরোধে দুই সিটি কর্পোরেশন যে পদক্ষেপই নিচ্ছে তা কার্যকর নয় বলে অভিযোগ নগরবাসীর।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত  হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪৩ জন। এদের মধ্যে ৪২ জনই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন     ৩১০ জন।

 বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষায় এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। তাই এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে কয়েকগুণ। অন্য অঞ্চল থেকে রাজধানীতে ঝুঁকিটা বেশি থাকে। জুন থেকেই ডেঙ্গুর মওসুম শুরু হয়। যদি ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হয় তবে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। তাই মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। 

তা ছাড়া ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিরোধে যে চিরুনি অভিযান করছে তা কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। এছাড়া নির্মাণাধীন ভবনগুলো ও খোলা পাত্রে এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। বৃষ্টি হলে ভবনের ভেতরে-বাইরে নানান জায়গায় পানি জমে থাকে। ফলে ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সবখানেই এডিস মশার লার্ভা মিলছে। তাই জনগণকে জরিমানা করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বরং জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। পাশাপাশি বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখার জন্য প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও কার্যকর কীটনাশক ওষুধ ছিটাতে হবে, মশকনিধন কর্মীর সংখ্যাও বাড়াতে। পাশাপাশি আন্তরিকতার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে সব কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। 

নগরবাসী বলছে, এখন হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমছে এবং মশাও বাড়ছে। মশার কামড়ে আমরা অতিষ্ঠ। সকাল-বিকাল ওষুধ ছিটানোর কথা থাকলেও তা ছিটানো হচ্ছে না। যে পরিমাণ ছিটানো হচ্ছে তা কোনো কাজেই আসছে না। ফলে দিনের বেলাতেও মশারি টানাতে হয়। জানালা বন্ধ  করে রেখেও মশার উপদ্রব কমছেই না বরং বেড়েছে। রাজধানীর সব এলাকায় ওষুধ ছিটানো হয় না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে অনেক সময় ওষুধ ছিটানো হয়। তখন মশা কিছুক্ষণের জন্য সরে যাচ্ছে। যখন মশা মারার ধোঁয়া সরে গেলে আবারো মশার কামড় শুরু হয়ে যায়। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানায়, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অঞ্চলভিত্তিতে মশককর্মীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জনসম্পৃক্তকরণের অংশ হিসেবে আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় মশক সুপারভাইজাররা হ্যান্ড মাইকে জিঙ্গেল বাজাবে। বছরব্যাপী মসজিদে জুমার নামাজের খুতবার আগে ইমাম সাহেব যে সমস্ত এলাকায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কীটনাশক প্রয়োগ হয়নি সেগুলোর তালিকা নিয়ে পরের দিন শনিবার কাউন্সিলর অফিসে জমা দেয়ার জন্য বলবেন এবং কাউন্সিলররা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে করণীয় উল্লেখযোগ্য তথ্য সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হবে। আষাঢ় আশ্বিন (চার মাস) প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে মোট ১০ জন নির্বাহী মাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাসে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে ওয়ার্ডভিত্তিক বাড়িতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে। 

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন জানায়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং এবং বিকেলে ফগিং করা হচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিটি ওয়ার্ডে মাইকিং করা হচ্ছে। প্রতি শনিবার স্লোগানের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এডিস মশার লার্ভা নিরসনে সব প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হচ্ছে। 

এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্তবিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে এ মুহূর্তে যেটা দরকার তা হলো— এডিশ মশা যে পাত্রে জন্মায় সে পাত্রকে আগে ধ্বংস করতে হবে। কোনো পাত্রে বা উন্মুক্ত স্থানে সাত দিনের পানি যেন জমে না থাকে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। এমনকি রাস্তাঘাটেও যাতে পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে দুই সিটি কর্পোরেশনকে তদারকি বাড়াতে হবে। ডেঙ্গুর মওসুম সাধারণত জুন থেকে শুরু হয়, আর শেষ হয় অক্টোবরে। দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। কারণ, দেশে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, এতে বিভিন্ন স্থানে পানি জমছে। এই জমা পানিতে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। এডিস মশা নির্মূলে কীটনাশক ছিটাতে হবে। মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আলাদা হতে হবে। মশাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনার।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার চারটি অংশ রয়েছে। প্রথমত, মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সহজভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, জীবজ নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা। আর জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া কঠিন। তাই এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার।’

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্ষার এ সময়টা হলো ডেঙ্গুর মওসুম।  মার্চ এপ্রিল থেকে শুরু হয় এটা কখনো কখনো আগস্ট সেপ্টেম্বর আবার কখনো কখনো নভেম্বর ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন এডিস মশার সাথে বৃষ্টিপাতের একটা সম্পর্ক আছে। পানি ছাড়া এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে না। যখন বৃষ্টিপাত হয় তখন বিভিন্ন স্থানে পানি জমতে থাকে। বৃষ্টির সময় এডিস মশার প্রজননের জায়গা বেড়ে যায়। 

তাই প্রজননের জায়গা বেড়ে গেলে এডিস মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। এডিস মশা বৃদ্ধি পেলে ডেঙ্গু বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই এডিস মশা যাতে না বাড়ে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। এ সময় জনসম্পৃক্ত কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। সিটি কর্পোরেশনগুলো, পৌরসভাগুলো, তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করে, তাহলে এডিস মশার প্রজননস্থলগুলো হওয়ার যে ঝুঁকি সেটা কমাতে পারে। তখন এডিস মশা কমবে এবং ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকিটাও কমবে।’

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সেন্ট্রাল কাউন্সিলর ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে মশার প্রজনন ধীরে ধীরে বাড়ছে। আর সামনে যখন বর্ষাকাল আসবে তখন তো মশা প্রজননের বড় মওসুম। তাই বৃষ্টিতে গাছের টব, খোলা পাত্র, নারিকেলের খোসাসহ খোলা স্থানে বা গর্তে পানি জমলে তা দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত বাসা বাড়িও পরিষ্কার রাখা। রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকিটা একটু বেশি থাকে। এছাড়াও রাতে বা দিনে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। কারো যদি জ্বর হয় তাহলে টেস্ট করানো ভালো। সচেতনতার মাধ্যমে আমরা এডিস মশা বা ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে পারি।’ সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকার দুই সিটি মেয়রকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।