তৈরি হচ্ছে বিতর্কিতদের আমলনামা

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২২, ০১:২৭ এএম
তৈরি হচ্ছে বিতর্কিতদের আমলনামা

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঘরের কাজে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ। তৈরি হচ্ছে দল মনোনীত সংসদ সদস্যদের আমলনামা। ইতোমধ্যে কয়েকটি সংস্থার রিপোর্ট জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্যের আমলনামায় অসন্তুষ্ট খোদ দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা। 

এসব সাংসদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অঢেল সম্পদের মালিক, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পুনর্বাসন, দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি, আলাদা বলয় তৈরি, দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।  

আগামীতে তাদের মনোনয়ন পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও সংসদ সদস্যদের নিয়ে কাজ করছেন দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তারা দলীয় রিপোর্ট  তৈরি করছেন বলে জানা গেছে। 

আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় সূত্র মতে, বর্তমান সরকারের সময়ে গত ১৩ বছরে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ উন্নয়ন হলেও অনেক সংসদ সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের অর্জন হারিয়ে যাচ্ছে। ওইসব সংসদ সদস্যের প্রতি দল ও সরকারের হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন সময়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের সতর্ক করেছেন। 

সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় ব্যবস্থা নেয়া না হলেও আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না। ওইসব আসনে আসবে নতুন মুখ। দলের জন্য নিবেদিত, দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত, স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। সংসদীয় আসন ঘিরে সংসদ সদস্য ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাংগঠনিক খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবেন দলের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। 

দায়িত্বশীল সূত্র মতে, টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ একের পর এক উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে দেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু ক্ষমতাকালে ভিন্নরূপ দলটির নিজ ঘরে। 

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দল, বিভাজন ও গ্রুপিংয়ে বিভক্তি তৃণমূল আওয়ামী লীগ। দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট এসব দ্বন্দ্ব নিরসনে বারবার তাগিদ দিয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কিন্তু তার সেই নির্দেশনা কাজে আসেনি। দলীয়প্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজ নিজ এলাকায় ক্ষমতার রাজত্ব করছেন স্থানীয় এমপিরা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ছিলেন নৌকাবিরোধী। সরাসরি মদত দিয়েছিলেন বিদ্রোহীদের। নিজ বলয় ভারী করতে দলের দায়িত্বশীল পদ-পদবিতে পুনর্বাসন করেছেন বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের। 

সংসদ সদস্যদের পারিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে তৃণমূলে অবমূল্যায়িত হয়েছেন ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা।  দুর্দিনে দলের নেতৃত্বে দেয়া নেতাদের থেকে সরকারের সুযোগ-সুবিধার সুফল পেয়েছে নব্য আওয়ামী লীগ বা এমপির পছন্দনীয় লোকজন। 

অতীতে যারা এমপির মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন, অনিশ্চয়তায় পড়ে তাদের রাজনীতি। দল বা সরকারি কর্মকাণ্ডে কোথাও তাদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে প্রায় প্রতিটি আসনে স্থানীয় সাংসদের বিরুদ্ধে সাথে তৃণমূল নেতাদের বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।

যার কারণে ওইসব আসনে নৌকার ভোটব্যাঙ্ক তলানিতে চলে এসেছে। এত উন্নয়ন করার পরও ওইসব আসনে আগামীতে জয় পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। যার কারণে প্রার্থী বদল করা ছাড়া উপায় দেখছেন না দলের দায়িত্বশীল নেতারা। অনেক স্থানে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। যা নিয়ে দলের একাধিক কার্যনির্বাহী সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

অতি সম্প্রতি কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার।  রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এক কলেজ অধ্যক্ষকে পেটানোর ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। 

এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহে জাতীয় সংসদ ভবনের এলইডি হলে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যানকে থাপ্পর দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেন কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। 

সরকারি কর্মকর্তা, দলীয় নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ পিটিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন। এই সংসদ সদস্য ২১ মে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা বাজার সংলগ্ন স্লুইসঘাট এলাকায় সালিশি বৈঠক ডেকে এক মাছ ব্যবসায়ীকে চড়থাপ্পড় মারেন। 

১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের বিরুদ্ধে।

লাঞ্ছিত দুই শিক্ষক হলেন পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও গণিতের সহকারী অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক দলিল লেখককে ঢাকা-৫ আসনের এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মারধর করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে শতাধিক এমপির ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয় আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী ফোরাম। মূলত ওই সব সংসদ সদস্যের কারণে ম্ল্লান হয়েছে আওয়ামী লীগের সব অর্জন। তাদের তালিকা হাইকমান্ডে পাঠানো হবে। 

পঞ্চম উপজেলা পরিষদে সরাসরি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডাক্তার আব্দুল আজিজ। তার নিজ কেন্দ্রে নৌকা হেরেছে বিপুল ভোটে। দলীয় নেতাদের দ্বিধা দ্বন্দ্বে বিভক্ত বেলকুচি-চৌহালি আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এখানে এক পক্ষে নেতৃত্বে দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, অন্য পক্ষে স্থানীয় সংসদ আব্দুল মমিন মণ্ডল। একই অবস্থা সিরাজগঞ্জ সদর আসনেও। 

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরকে নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছেন তিনি। দামুড়হুদা উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম। 

কেন্দ্রের বিবেচনায় বাদ পড়ে, বিদ্রোহী হন আলী আজগর টগরের আপন ছোট ভাই দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আলী মনসুর। তিনি সাংসদ ভাইয়ের দাপটে গোঠা নির্বাচনি এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জয়লাভ করেন। এছাড়া গত জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনেও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এই সংসদ সদস্য।  

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথমে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান স্থানীয় সাংসদ এবাদুল করিম বুলবুলের মনোনীত প্রার্থী হাবিবুর রহমান স্টিফেন। কিন্তু ওই প্রার্থীর দ্বৈত নাগরিকত্বসহ বিএনপি-জামায়াতের সাথে আঁতাত থাকার অভিযোগ মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের মনোনয় পান জহির উদ্দিন সিদ্দিক টিটু। 

কিন্তু ওই প্রার্থী মনঃপূত না হওয়ায় প্রকাশ্যে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. নাছির উদ্দিনের পক্ষ নেন তিনি। যা নিয়ে উপজেলাজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে একাধিক সংস্থার রিপোর্টে।   

এছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা বিতর্কিত কাজে আলোচনায় উঠা আসা এমপিদের মধ্যে রয়েছেন— কক্সবাজার-৩ সাইমুন সরওয়ার কমল, চট্টগ্রাম-১২ সামছুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১১ এম আব্দুল লতিফ, লক্ষ্মীপুর-১ আনোয়ার হোসেন খান, নোয়াখালী-৪ একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনী-২ নিজাম উদ্দিন হাজারী, নোয়াখালী-৩ মামুনুর রশিদ, চাঁদপুর-২ নুরুল আমিন রুহুল, কুমিল্লা-২ সেলিমা আহমেদ, সুনামগঞ্জ-১ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ফরিদপুর-৩ খন্দকার মোশারফ হোসেন, ফরিদপুর-১ মঞ্জুর হোসেন বুলবুল, নরসিংদী-৫ রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, ঢাকা-১৭ ফারুক, ঢাকা-১৫ কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা-১৩ সাদেক খান, ঢাকা-৭ হাজী সেলিম, ঢাকা-৫ মনিরুল ইসলাম মনু, মানিকগঞ্জ-১ নাইমুর রহমান দুর্জয়, কিশোরগঞ্জ-৫ আফজাল হোসেন, কিশোরগঞ্জ-২ নুর মোহাম্মদ, ময়মনসিংহ-১০ ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল,  ময়মনসিংহ-৬ মোসলেম উদ্দিন, জামালপুর-৪ মুরাদ হাসান, পটুয়াখালী-৩ এসএম শাহজাদা, যশোর-৬ শাহিন চাকলাদার, পাবনা-৫ গোলাম ফারুক খন্দকার পিন্স, নাটোর-২ শফিকুল ইসলাম শিমুল, ঠাকুরগাঁ-২ দবিরুল ইসলাম, দিনাজপুর-২ মনোরঞ্জন শীল গোপাল, দিনাজপুর-৬ শিবলী সাদিক, জয়পুর হাট-১ শামসুল হক দুদু, নওগাঁ-৩ সলিমদ্দিন তারফদার, কুষ্টিয়া-৩ মাহবুব-উল আলম হানিফ, যশোর-১ শেখ আফিল উদ্দিন, সাতক্ষীরা-২ মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, বরগুনা-১ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ঝালকাঠি-১ বজলু হক হারুণ, সিলেট-৬ নুরুল ইসলাম নাহিদ, চট্টগ্রাম-৪ দিদারুল আলম, সিরাজগঞ্জ-২ হাবিবে মিল্লাত মুন্না।  

এসব সংসদ সদস্যে নারাজ দলের হাইকমান্ড। ওইস সংসদ সদস্যরা মূলত কুক্ষিগত করে রেখেছেন সংগঠনকে। বিরোধী শিবির বিএনপির থেকে দলে এনে জনপ্রতিনিধি করার ঘটনাও ঘটেছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁও পৌরসভার বর্তমান মেয়র ইকবাল হোসেন সুমন। 

তিনি আগে ঢাকার হাজারীবাগ থানা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন এবং ময়মনসিংহের বিএনপি ঘরানার কয়েকটি পরিবারের মধ্যে অন্যতম। ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল অর্থের বিনিময়ে দলে এনে মেয়র বানিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত দুই বছরে দলের কার্যনির্বাহী সভা, মন্ত্রিপরিষদ সভায় একাধিকবার বিতর্কিত এমপিদের সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটেছে, সেটি আমার দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে কেউ দলকে উপেক্ষা করলে তা অবশ্যই সাংগঠনিক রিপোর্টে তুলে ধরা হবে এবং নেত্রী বিবেচনা করবেন।’ 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম আমার সংবাদকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের সবগুলো নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দেয়। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েই দল গোছানোর কাজ করা হচ্ছে। 

একইভাবে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক (নৌকা) নিয়ে নির্বাচিত হয়ে কেউ যদি দলের ভাবমর্যাদা নষ্ট করে, দলের সুম্মান ক্ষুণ্ন করে, দলীয় অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং দলকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং দলের মুখোমুখি করা হবে। ব্যক্তিস্বার্থের জন্য দলীয় স্বার্থ নষ্ট হতে দেয়া হবে না। সে দিকে দৃষ্টি দিয়েই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।