অবসরে অসহায়ত্ব

বেলাল হোসেন ও মেহেদী হাসান মাসুদ প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২২, ০২:১১ এএম
অবসরে অসহায়ত্ব

জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এক কঠিন যুদ্ধের সম্মুখীন হোন। অবসরের টাকাটা সঠিক সময়ে না পেয়ে নিদারুণ আক্ষেপ নিয়ে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন অহরহ শিক্ষক কর্মচারী। বছরের পর বছর এ সেকেলে সিস্টেম চলে আসছে।

এর সমাধানে নেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বালিয়াকান্দি উপজেলার আড়কান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মুজিবুর রহমান।

গত জানুয়ারি-২০২০ অবসরে যান। সে বছরেই তিনি অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনপত্রের রিসিভ কপিতে বলা হয় ২০১৭ জুন পর্যন্ত দরখাস্তের কাজ চলছে।

পরবর্তীতে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থতা নিয়ে অবসর বোর্ডে ঘুরেও কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি। গত ২০ জুন তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শালমারা নিশ্চিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আহম্মেদ আলী প্রায় ৩১ বছর চাকরি জীবন শেষ করে ২০১৭ সালে অবসরে যান। প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতায় আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলে দাবি পরিবারের।

৬ মার্চ ২০২০ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষক মুজিবুর রহমান কিংবা আহম্মেদ আলী নন, এমন দুভার্গ্য দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের যেন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবসর নেয়ার পর প্রাপ্য সুবিধা পাওয়া যেন সোনার হরিণের মতো। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনেকের ভাগ্যে এ সুবিধা মিললেও কেউ কেউ তার আগেই মৃত্যুবরণ করছেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক কল্যাণে শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট কাজ করে থাকে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে অনলাইনে আবেদন শুরু হয়। শুরুর পর থেকে ৭ এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৬৭৫ জন এমপিওভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা পেতে অনলাইনে আবেদন করেছেন।

এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের অবসরপ্রাপ্ত মোট ১২ হাজার ৩৫৪ জন আবেদন করেছেন। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের অবসরপ্রাপ্ত ৯ হাজার ২৭৩ জন শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে, যারা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবেদন করেছিলেন।

অনলাইনে আবেদনকারীদের মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ২৯ হাজার ১৩১ জনকে এ পর্যন্ত তিন হাজার ৫৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৯ হাজার ২২১ টাকা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বরাদ্দও দিয়ে থাকেন।

গত মে মাসের অবহিতকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জমাকৃত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ক্যাটাগরির আবেদনসমূহ অডিট নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ২০১৯ সালের মে এবং জুন মাসে জমাকৃত আবেদনসমূহের নিষ্পত্তির কাজ চলছে। ২০২০-২২ সালে যারা আবেদন করেছেন তাদের আবেদন অগ্রিম নিষ্পত্তির কোনো সুযোগ নেই।

একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদনের কপিতে দেখা যায়, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে যারা আবেদন করেছেন তাদের আবেদনে ২০১৭ জুন পর্যন্ত দরখাস্তের কাজ চলছে। ২০২২ সালের মে মাসের আবেদনে ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তির কাজ চলছে।

প্রতিটি আবেদন পরবর্তীতে প্রাপ্তির তালিকার নথিভুক্ত হতে সময় লাগছে তিন বছরের অধিক। প্রতি মাসে অবসর সুবিধা প্রাপ্তিতে প্রায় হাজার খানেক আবেদন জমা হয়। তিন মাসের স্লটে প্রায় দুই হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকার কারণেই অবসর-পরবর্তী আর্থিক সুবিধা দিতে পারছেন না তারা।

ভুক্তভোগী মতিয়ার রহমান লাভলু বলেন, আমার বাবা ২০২০ সালে অবসরে গিয়ে ছয় মাসের মধ্যেই অনলাইনে আবেদন করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় আমার বাবা মুজিবুর রহমান অবসর বোর্ড, কল্যাণ ট্রাস্টে গিয়েও কাজ হয়নি। আমিও একাধিকবার গেছি। আমার বাবার মুমূর্ষু ছবি তাদের দেখিয়েছি। মাস খানেক আগে আমার বাবা মারা গেছেন।

সারা জীবন শিক্ষকতা করে জীবনের শেষ মুহূর্তে নিজের প্রাপ্য হাতে না পাওয়া বড়ই কষ্টদায়ক। আজও কল্যাণ ট্রাস্ট কিংবা অবসর বোর্ড কর্তৃক আর্থিক সুবিধা পাইনি। জানি না কবে পাবো। একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরপরই তার প্রাপ্য বুঝে দেয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হরিশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অবসরে গেছি। মার্চ মাসে আবেদন করেছি। আগে মাস শেষে যা পেতাম তাই দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করতাম। এখন তো কিছুই পাই না। বড্ড অসহায় লাগে। বেতনের ১০ শতাংশ হারে কর্তন করে শেষ জীবনে এসে নিজের সঞ্চিত অর্থ না পাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের, অসহায়ত্ব! অবসরের সাথে সাথেই প্রাপ্য অর্থ দেয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অবসর সুবিধা বোর্ডের উপপরিচালক (প্রশাসন) বারুণী রঞ্জন বিশ্বাস আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে ২০১৯ সালের আবেদনের কাজ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। প্রতি মাসে যে পরিমাণ আবেদন হয় তাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রযোজন হয়। সেখানে ৫৫-৫৬ কোটি টাকা পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর থোক বরাদ্দ থেকে কিছু পাওয়া গেলে একটু সুবিধা হয়।’

উপপরিচালক আরও বলেন, ‘বর্তমানে ৪০ হাজার আবেদন পেন্ডিং হয়ে আছে’। অর্থের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত রমজানে যে আবেদনগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে সেগুলোর টাকা এখনো ব্যাংক ছাড় করা সম্ভব হয়নি।’