জালিয়াতির অংশীদার এনআরবিসির পর্ষদ

ঋণের টাকায় জামানত ক্রয়!

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২২, ০১:১৪ এএম
ঋণের টাকায় জামানত ক্রয়!

জালিয়াতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এনআরবিসি ব্যাংক। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানত রাখার বিধান থাকলেও উল্টো জামানত কিনতে টাকা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন যথাযথ খাতে ঋণ বিতরণ হয়নি, অপরদিকে ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে।

এছাড়া এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে যার ওই পরিমাণ অর্থ ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। স্পষ্ট অনিয়ম দেখেও পরস্পর যোগসাজশে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা  হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

পর্যবেক্ষকদলের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নিয়মের তোয়াক্কা না করেই পাবনার পাপা রোমা নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে অভিনব কায়দায় পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের সভাপতিত্বে ৭৮তম সভায় ওই ঋণের অনুমোদন দেয়া হয়।

এতে দেখা যায়, যে জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেয়ার কথা, উল্টো সেই জমি কেনার জন্য টাকা দিয়েছে ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রাহককে জামানত কেনার জন্য টাকা দেয়া হয়েছে। ঋণ বিতরণে এমন অনিয়মকে সুস্পষ্ট জালিয়াতি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকটির পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর শাখা থেকে পাপা রোমা কনসালটেন্সি ফার্মের মালিক মো. সাইফুর রহমানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণের জামানত হিসেবে ১৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ জমির কাগজপত্র জমা দেয়া হয়।

তবে জামানতের জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন না সাইফুর রহমান। স্বাভাবিক কারণে ঋণটি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ জেনেশুনেই ওই ঋণ অনুমোদন দেয়, যা ব্যাংকিং আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের প্রতিবেদনে আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের দায়ী করা হয়েছে।

পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, কনসালটেন্সি কাজে ঋণের টাকা ব্যবহারের পরিবর্তে জামানতের জমি রেজিস্ট্রেশন করতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয় পরিচালনা পর্ষদ। অর্থাৎ, সাইফুর রহমান নিজের মালিকানা দাবি করে জমি কেনার আগেই তার কাগজপত্র ব্যাংকের জামানত হিসেবে জমা দেন। জমি রেজিস্ট্রেশন ও টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শকদল।

এতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঋণের টাকা নিয়ে জমির মালিক শেখ আরশাদ গফুরকে চেকের মাধ্যমে প্রথম দফায় দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। ওই দিন টাকা পরিশোধের পরই মো. সাইফুর রহমানের নামে ১ দশমিক ০৮৩৭ একর জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। একই বছরের ৪ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় জমির মালিক হিসেবে রেজাউল করিম ও শেখ আরশাদ গফুরের নামে চেকের মাধ্যমে দুই কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। একইভাবে দ্বিতীয় দফায় টাকা পরিশোধের তিন দিন পরে ৭ এপ্রিল ০.১০৬৩ একর জমি পাপা রোমার মালিক সাইফুর রহমানের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।

এভাবে মূলধনি তহবিলের জন্য দেয়া ঋণের টাকা জমি কেনায় ব্যবহূত হয় এবং ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের সময় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তমাল পারভেজসহ সংশ্লিষ্ট পরিচালক, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঋণের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা জেনেশুনে ঋণ দেন, যা ২০১৮ সালের ব্যাংক প্রবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে অপরাধের সাথে জড়িত হিসেবে এসইও ও ক্রেডিট ইনচার্জ মো. মাইনুল হোসেন, এসইও ও ম্যানেজার অপারেশন মো. ইমতিয়াজ হোসেন, এফএভিপি ও শাখা প্রধান রাশেদুল আলম, ইভিপি ও হেড অব সিআরএম তনুশ্রী মিত্র, তৎকালীন ডিএমডি কাজী মো. তালহা, ডিএমডি মো. মুকতার হোসেন ও তৎকালীন এমডিকে দায়ী করা হয়।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জামানত কিনতে টাকা দিলেও ঋণ প্রস্তাবে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম জমি কেনা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণটিতে অপর্যাপ্ত জামানত রাখা হয়েছে, বা পর্যাপ্ত জামানত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংক। ঋণের জন্য দুই দফায় বন্ধকী জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ দশমিক ৮৫ শতাংশ আর ঋণ প্রস্তাবনায় ছিল ১৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ।

এছাড়া ঋণের বিধি অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষ থেকে মূল্যায়ণ করে জমির মূল্য নির্ধারণ করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। বরং মূল্যায়ণ ছাড়াই জমির ইচ্ছামাফিক মূল্য উল্লেখ করে ব্যাংকের সিআরএম ডিভিশন কর্তৃক পরিচালনা পর্ষদে মেমো উপস্থাপন করা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট জালিয়াতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পর্ষদ পুরোপুরি অবগত ছিল। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনে বন্ধকী ও অন্যান্য কাগজপত্র দিয়ে বন্ধকের আগেই পাঁচ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ নেন পাপা রোমা প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুর রহমান।

অভিনব ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে এনআরবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া আমার সংবাদকে বলেন, ‘ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে যেহেতু বিষয়টি উঠে এসেছে, তাই এটি নিয়ে মন্তব্যের অবকাশ নেই।’