সরকারি সাক্ষীতে ভোগান্তি

শরিফ রুবেল প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২২, ১২:২৪ এএম
সরকারি সাক্ষীতে ভোগান্তি

২০০৭ সালের ১০ এপ্রিল। জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিদপুর গ্রামে দুই প্রতিবেশী মোতালেব শেখ ও লাবলু শেখের মাঝে সংঘর্ষ হয়। এতে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন লাবলু শেখ। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সনদ নিয়ে দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় মামলা করেন লাবলু।

ওই মামলায় ২০ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার প্রত্যাক্ষদর্শী সাক্ষী করা হয় ১১ জনকে। তবে মামলার সব আসামি জামিনে মুক্তি পেলেও মামলা এখনো ঝুলে আছে। পুলিশ ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। তারপরও ১৫ বছরে মামলার বিচার শেষ হয়নি। সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিচারকাজ আটকে আছে। অধিক সাক্ষীতে দীর্ঘ সময়েও মামলার বিচারিক জটলা কাটছে না।

গত ১০ বছরে পর্যাক্রমে সবাই সাক্ষ্য দিলেও বাকি রয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসক। বদলিজনিত কারণে দুজনের কাউকেই আদালতে হাজির করা যায়নি। কে কোথায় আছেন তাও জানেন না রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের খোঁজ করতে চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। পূর্বেও কর্মস্থলে নোটিস ও একাধিকবার সমন দিলেও কেউই আদালতে আসেনি। ফলে দুই সরকারি সাক্ষীতে বিচার আটকে আছে প্রায় একযুগ। আসামিরাও আদালতে হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। যে হাজিরার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। আপসযোগ্য মামলাও চলছে বছরের পর বছর।

২০১৩ সালের আগস্ট মাসে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শ্রীপুর থানায় একটি মামলা হয়। আদালতে উপস্থাপিত নথি অনুসারে ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী পাঁচজনের চিকিৎসা ও আহতের প্রতিবেদন দিয়েছিলেন চিকিৎসক মো. মাহফুজুর রহমান। সে সময় শ্রীপুর উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ওই চিকিৎসক। মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৪ বার মামলার সাক্ষী হিসেবে হাজির হওয়ার জন্য এই চিকিৎসককে চিঠি দেন আদালত। কিন্তু তিনি একবারও হাজির হননি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, সিআরপিসি ৪৮৫ এ ধারায় মাহফুজুর রহমানকে ২০০ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে ও সংশ্লিষ্ট বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসক একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রের মামলায় সাক্ষ্য দেয়া তার দায়িত্ব। বারবার আদেশের কপি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানোর পরও আদালতে হাজির না হওয়া আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট অবহেলা যা আইনত শাস্তিযোগ্য।

১৯৯৮ সালে ডেমরা থানায় দায়ের হওয়া হযরত আলী হত্যামামলা ২১ বছরেও নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারককে তলব করেন হাইকোর্ট। নির্ধারিত দিনে ওই মামলার বিচারক ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আলী হাজির হয়ে হাইকোর্টকে জানান, এক বছর ধরে মামলাটির দায়িত্বে তিনি। তবে বারবার সমন জারি করার পরও সাক্ষী উপস্থিত হচ্ছিল না। এক্ষেত্রে বিচারকের কী করার আছে? বিচারকের উপস্থিতিতে হাইকোর্ট বলেছেন, সমন জারির পরও কোনো সরকারি কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালতে উপস্থিত না হলে পুলিশ, র্যাব ও ডাক্তারসহ কোনো সরকারি কর্তকর্তার সাক্ষ্য না দেয়ার কারণে যদি মামলা ডিলে হয় তাহলে বেতন কেটে নেয়ার বা বেতন আটকে দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে আদালতের আদেশ কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি।

শুধু লাবলু শেখ ও হযরত আলীর মামলাই নয়, সারা দেশে মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ও চিকিৎসকের সাক্ষ্য দিতে হাজির না হওয়ায় লাখ লাখ লঘুদণ্ডের মামলা নিষ্পত্তিতেও কেটে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। এতে বিচার বিভাগের ভোগান্তি বাড়ছেই। মামলা শেষ করতে আদালতে হাজিরা দিয়ে ক্লান্ত হন বিচারপ্রার্থীরা। অনেকে হাজিরা খরচ ও মামলার ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হয়ে বিক্রি করেন জমি-জিরাতও। তবুও মামলা শেষ হয় না।

আইনজ্ঞরা বলেন, সরকারি সাক্ষীদের (চিকিৎসক, পুলিশ কর্মকর্তা) কর্মস্থল পরিবর্তনের (বদলি) কারণে নির্ধারিত ঠিকানায় না পাওয়া ও আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারীর অসৎপন্থা অবলম্বনের কারণে আদালত সাক্ষীর সংকটে পড়ে। এসব কারণে মামলা ঝুলে যায়। এজন্য লঘু দণ্ডের মামলাও নিষ্পত্তি হতে যুগ যুগ লাগে। হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠনের পর এক যুগেও কোনো সাক্ষী হাজির না হওয়ার নজির আছে। মামলা প্রমাণের প্রধান নিয়ামক হলো সাক্ষী।

ফৌজদারি মামলা সাক্ষী ছাড়া টিকে না। আদালত সাক্ষ্য-প্রমানের ওপর ভিত্তি করেই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, চিকিৎসক, আসামির জবানবন্দি, জব্দ আলামত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, এসবের ওপর মামলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এদিকে তদন্ত, চার্জশিট দাখিলে গাফিলতি ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলা নিষ্পত্তির মূল বাধা— এমনটিই জানান আইনজীবীরা।

তারা বলেন, আদালতে সাক্ষী করতে না পারার দায় রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতিতেই যেকোনো মামলার সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয় না। অপরদিকে আইন কর্মকর্তাদের দাবি, মামলাগুলোতে যেসব সরকারি সাক্ষী থাকে তাদের হাজির করা কঠিন, তাই সহজে বিচার কাজ শেষ করাও কঠিন। অধিকাংশ ছোট অপরাধের মামলায় এসব সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত। সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন দিলেও তারা আদালতে উপস্থিত হন না। এতে তাদের কোনো দায় নেই।

ফৌজদারি মামলায় অভিযোগের তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১ (২) (১) উপধারা অনুযায়ী, মামলার ফরিয়াদি (বাদী) বা সাক্ষী মামলার শুনানিকালে যাতে আদালতে হাজির হয় তা নিশ্চিত করা পুলিশ কর্মকর্তার (তদন্তকারী কর্মকর্তা) দায়িত্ব। তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেও একজন সাক্ষী। অভিযোগ গঠনের পর বিচার শুরু হলে সাক্ষীদের কাছে শুনানির তারিখ উল্লেখ করে সমন পাঠানো হয়। ধার্য তারিখে সাক্ষী হাজির না হলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পরোয়ানা জারি হয়। এরপরও সাক্ষী গরহাজির থাকলে জামিন অযোগ্য পরোয়ানা জারি হয়। তবে যেসব মামলায় ১০ জনের অধিক সাক্ষী রয়েছে।

এমন বেশকিছু ফৌজদারি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিচারিক আদালত থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত এসব মামলা যুগ যুগ ধরে চলছে। সব সাক্ষীকে হাজির করতে না পরার কারণেই মামলার বিচার শেষ করা যায়নি। কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অনুযোগ, খুন কিংবা ধর্ষণসহ গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের মামলায় অনেক ক্ষেত্রে অযাচিত কিংবা এমন সব সাক্ষীকে অভিযোগপত্রে রাখা হয় যারা আসলে ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাদের আদালতেও আনা যায় না।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, মামলায় অভিযোগ প্রমাণে যতসংখ্যক সাক্ষীর প্রয়োজন, তা তালিকায় রাখতে হয়।

জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, সাক্ষীরা ঠিকানা পরিবর্তন করলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সমন দিলেও তাদের কাছে পৌঁছায় না। সাক্ষীর সংখ্যা নয়, সঠিকভাবে সাক্ষ্য নিয়ে মামলা শেষ করতে হয়। সাক্ষীর অপরিহার্যতা ও সংখ্যা নির্ভর করে মামলার গুরুত্বের ওপর। আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে হয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যক্ষ সাক্ষীর মাধ্যমে।’

জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, এ ধরনের মামলায় চিকিৎসকের জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে মেডিকেল সার্টিফিকেট ভুক্তভোগীরা উপস্থাপন করেছেন তা সঠিক নাকি ভুয়া তা বলতে পারবেন কেবল ওই চিকিৎসক। এই সাক্ষী ছাড়া মামলার বিচারপ্রার্থীদের সঠিক বিচার পাওয়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে যাবে। তা ছাড়া অনেক মামলায় বাকি সব সাক্ষী গ্রহণ শেষ হয়েছে। কেবল চিকিৎসকের এই সাক্ষীর জন্য মামলাটা ঝুলে আছে। নানা চেষ্টা করেও সাক্ষীদের হাজির করা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আসামিরা খালাস পেতে পারেন মামলায়।