চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাধারণত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অন্যান্য মাসের তুলনায় অর্থবছরের শেষ মাসে বেশি রাজস্ব আদায় করে থাকে। কিন্তু গত এপ্রিলে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুরু হওয়া আন্দোলনে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম কার্যত ঢিলেঢালা ছিল। এরপর শুরু হয় ঈদের টানা ১০ দিনের ছুটি। তখন রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
প্রায় এক মাসের এই ঢিলেঢালা কার্যক্রমে সবমিলে এনবিআর রেকর্ড ঘাটতির মুখে পড়ছে। তাছাড়া জুলাই আন্দোলন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও রাজস্ব আহরণ কমেছে।
যদিও সরকার রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করেছে। তবুও বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁটের পরও রাজস্ব ঘাটতি প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ অর্থবছরের শুরু থেকে রাজস্ব আহরণে বিরূপ পরিস্থিতি ছিল। তারপরও রাজস্ব আহরণে কিছুটা স্বস্তি এলেও অর্থবছরের শেষ দুই মাসে রাজস্ব আহরণে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টানা আন্দোলন ও টানা বন্ধে রাজস্ব আহরণে রেকর্ড ঘাটতির মুখে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। মূলত দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে।
সূত্র জানায়, দেশের কর জিডিপি রেশিও বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। তার মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েই চলেছে। বছর শেষে বড় অঙ্কের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর ফাঁকির ফাঁকফোকর বন্ধ করা জরুরি। ওই লক্ষ্যে সুশাসন নিশ্চিত করে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে জোর দিতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বা মে মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ মূল লক্ষ্যমাত্রার হিসাবে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকার ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। ওই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হিসাব করলেও রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি জুনে আদায় করা অসম্ভব।
সূত্র আরও জানায়, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে খাতওয়ারি হিসাবে মে মাস পর্যন্ত কাস্টমস খাতে অর্থাৎ শুল্ক আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। আর ভ্যাট আদায় হয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা এবং আয়কর আদায় হয়েছে এক লাখ চার হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। আর একক মাস হিসেবে শুধু মে মাসে তিন খাত মিলিয়ে মোট রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩২ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। তার মধ্যে কাস্টমস খাতে ৯ হাজার ৪৬১ কোটি, ভ্যাট খাতে ১৩ হাজার ৩৭৪ কোটি ও আয়কর খাতে ৯ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে এনবিআর। একক মাস হিসেবে এর আগের মাস শুধু এপ্রিলে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ওই মাসে আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। গড়ে প্রতি মাসে এনবিআরের তিনটি খাত মিলে রাজস্ব আদায় করে ৩০ থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে তার প্রায় পাঁচগুণ আদায় করতে হবে। আর এই ধরনের সক্ষমতা এনবিআরের নেই।
এদিকে এনবিআর পৃথকীকরণের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের পর থেকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনানুষ্ঠানিক আন্দোলনে নামে। পরবর্তীতে ১২ মে গভীর রাতে এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির পর আনুষ্ঠানিক আন্দোলনে নামে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অবস্থান ধর্মঘট থেকে শুরু করে আংশিক কলম বিরতিতে এবং কর্মবিরতিতে যান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ঘোষণার পর গত ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর ঈদের টানা বন্ধের সময়ে প্রায় পুরোপুরি বন্ধই ছিল রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম। ওই বন্ধ ও ঢিলেঢালা রাজস্ব কার্যক্রমের সার্বিক রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের আর মাত্র ১৫ দিন বাকি আছে। এই সময়ে বিশাল এই রাজস্ব আহরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের ইতিহাসে এনবিআর চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়বে। কারণ অর্থবছরের শুরু থেকে আন্দোলন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে নতুন করে যোগ হয়েছে এনবিআর পৃথকীকরণে চলা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন। তাতে কার্যক্রম ছিল অনেকটা ঢিলেঢালা। এছাড়া ঈদের টানা বন্ধেরও রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব কারণে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়বে এনবিআর। তাছাড়া অলিখিতভাবে রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে অডিট ও প্রিভেন্টিভ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় রাজস্ব আহরণের গতিও কিছুটা কমেছে।
এনবিআরের আরও ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের তথ্যানুসন্ধান শুরু
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কমিশনারসহ আরও পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তথ্যানুসন্ধান শুরুর কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তারা হলেন ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থল বন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপ-কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা এবং কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধান শুরুর কথা গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম।
গত মাসে এনবিআরে সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আন্দোলন শুরু হয়। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে ওই আন্দোলনে এই পাঁচজনের অংশগ্রহণ ছিল। সেহেলা সিদ্দিকা ঐক্য পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে গত রবি ও মঙ্গলবার মোট ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধান শুরুর কথা বলেছিল দুদক। ওই ১১ জনের অনেকেই এনবিআরের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির ‘নেতৃত্বে’ ছিলেন।
দুদকের নথিতে বলা হয়, ‘কতিপয় অসাধু সদস্য ও কর্মকর্তা কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে তাদের করের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেন বলে জানা যায়।’ এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপরসারণ দাবিতে এক সপ্তাহের কলম বিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ও সবশেষ দুই দিনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ পালনের পর গত সোমবার থেকে কাজে ফেরেন আন্দোলনকারীরা। এনবিআরে টানা আন্দোলনের মধ্যে ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ দ্বিতীয় দিন রোববার নড়েচড়ে বসে সরকার। এনবিআরের সেবা ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করে আন্দোলনরতদের কাজে যোগ দিতে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। এর মধ্যেই আন্দোলনরত ছয় এনবিআর কর্মকর্তার ‘দুর্নীতির’ তথ্যানুসন্ধান শুরুর তথ্য দেয় দুদক। আর সংকট সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার কথা জানায় সরকার।
দিনভর নানা নাটকীয়তার মধ্যে পরে ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন অর্থ উপদেষ্টা। সেখানেই মেলে সমাধানের সূত্র। ওই বৈঠকে ‘ইতিবাচক আশ্বাসের’ ভিত্তিতে ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের মধ্যস্থতায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেয়। পরদিন কাজে ফেরেন এনবিআরের কর্মীরা।