দুর্গম পথ পেরিয়ে পরিণত আ.লীগ

মাহমুদুল হাসান অলড্রিন ও নুর মোহাম্মদ মিঠু প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২২, ০৯:৩৬ এএম
দুর্গম পথ পেরিয়ে পরিণত আ.লীগ

নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। ইতোমধ্যে প্রায় সব সহযোগী ও অঙ্গ-সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব যাত্রা শুরু করেছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ইতিহাসের নানা পথ পেরিয়ে, পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর নানা আন্দোলন-সংগ্রামে দলীয় কর্মীদের রক্ত ঝরিয়ে রাজপথে কাটিয়েছে দেশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দলটি। মওলানা ভাসানী, সৈয়দ শামসুল হক ও শেখ মুজিব নিয়ে পথ শুরু হওয়া আওয়ামী লীগ, অধিকার আদায়ের প্রশ্নে, বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বিকাশে সময়ের প্রয়োজনে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা আওয়ামী লীগের সব থেকে বড় অর্জন। পঁচাত্তরের  ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর মারাত্মক হোঁচট খায় দলটি। সদ্য স্বামী হারানো জোহরা তাজউদ্দীন ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় বিভ্রান্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। দলে ঐক্য ফেরানোর তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এক অনিবার্য পরিণতির মতোই যেন কাণ্ডারী হয়ে স্বজনের রক্তে ভেজা দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। অনেকেই তখন ঘরের দুয়ার খুলে পথে নামেননি। এর বিপরীতে লোক দেখানো দায় সারেননি জোহরা তাজউদ্দীনও।

এক গভীর দায়িত্ববোধে তাড়িত, বয়সকে বাধা মানেননি, দলকে গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বদানের যোগ্য করে তুলতে গভীর মমতায় পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সহযোগিতা করে গেছেন তিনি। আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে জেনারেল জিয়া সরকারের সামরিক স্বৈরশাসন। পঁচাত্তরের পর বিরাজনীতিকরণের ওই কঠিন দুঃসময়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চ্যালেঞ্জ মাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। যখনই কোনো কঠিন সময় এসেছে কেউ না কেউ অসীম দৃঢ়তায় ও প্রতিজ্ঞায় হাল ধরেছেন, দল পরিবর্তনের ডামাডোলের সময়টিতে অনেকে রুধির ধারার মতো কাজ করে গেছেন দেশের বৃহত্তম এই গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগের জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির এই ‘থিম’ আওয়ামী লীগের  জন্য চলার পথের পাথেয় হয়ে দলটিকে পথ দেখিয়েছে বারবার। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নানা সংকট এসে যখনই বাধা তৈরি হয়েছে; সময়, পরিণত নেতৃত্ব ও দলীয় আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আওয়ামী লীগ সেই বাধার দেয়ালকে পেরিয়ে চলার গতি বাড়িয়েছে নিজস্ব আঙ্গিকে।

জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক-স্বৈরশাসন, একে একে রাজপথে চিকিৎসক মিলন, নূর হোসেনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর রক্ত ঝরিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এই দুই সেনাশাসকের বিরাজনীতিকরণের তুমুল স্র্রোতে টিকে থাকতে হয়েছে খড়কুটোর মতো, টিকেও ছিল বহু ঝড়ে পর্যুদস্ত আওয়ামী লীগ। তারপর পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২১ বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগ।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা, বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষার মর্যাদা পাওয়া, দেশের অন্যতম বৃহৎ অবকাঠামো বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু উদ্বোধন করা প্রভৃতি ঐতিহাসিক কাজের সূচনা করে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় দু’দশক পর বিচার প্রক্রিয়ার শুরুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দায় মোচন  করে। ২০০১ সালের পর আরেকবার দমন-পীড়নের শিকার হয় আওয়ামী লীগ। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দেশের শাসনক্ষমতার অংশীদার হয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে। রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় দমন-পীড়ন একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

২০০২ সালের অপারেশন ক্লিনহার্টে টিকে থাকার রাজনীতিতে দেশের বৃহত্তম এই দলকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। রাজনীতিতে ছেদ পড়ে, খণ্ডিত হয় ঐক্য, কেন্দ্র থেকে  তৃণমূল; দলটির সব নেতাকর্মী অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনার চোখের সামনে তার দলের নেতাকর্মীদের মৃত্যু, এ দেশের রাজনীতিতে একটি জিঘাংসার অবতারণা করে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এই প্রচেষ্টায় দারুণ প্রশ্নের মুখে পড়ে গণতান্ত্রিক মূলবোধ। বিচ্ছিন্ন হওয়া অসংখ্য নেতাকর্মীর ঘুড়ে দাড়াতে সময় লাগে। বিভেদের রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। অবিমৃশ্যকারীতায় মেতে ওঠা বিএনপি ও সাম্প্রদায়িক শক্তি জামায়াতের বিপরীতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রাম থামেনি। বারবার নানামুখী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মাঠের রাজনীতিতে টিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া এই দলটি।

তারপর অনিবার্চিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর ভয়াবহ দমননীতি প্রয়োগ করে। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠানো হয়, সিনিয়র নেতাদের ক্রমান্বয়ে জেলে যেতে হয়। আবারও বিরাজনীতিকরণের তীব্র  স্র্রোতের মুখে পড়ে প্রাচীন এই আওয়ামী লীগ। আবারও মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। রীতিমতো রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে তারা। তবে অতীত অজ্ঞিতাকে পুঁজি  করে ও দলীয় প্রধানের অনমনীয়তায়, কঠিন সময়টি উতরে যায় তারা। অনির্বাচিত সরকারের নিজ দলের ক’জন সিনিয়র নেতার ‘সংস্কার প্রস্তাব’-এর প্রতি মৌন সম্মতির বার্তা দলের মধ্যে অবিশ্বাসের গুঞ্জন তোলে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। যে নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করে তা হলো— গণতন্ত্রের সংগাম অব্যাহত রাখা, মানুষের ভোটের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা। এই সব লক্ষ্যেই বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে কাজ শুরু করেন। ক্ষমতায় এসেই প্রথম জাতীয়  কাউন্সিলে দলের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। তথাকথিত ‘সংস্কারপন্থি’ ক’জন সিনিয়র নেতাকে  সভাপতিমণ্ডলীর পদ থেকে সরিয়ে দেন তিনি। বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে আসা পরিণত আওয়ামী লীগ দুঃসময়ের বন্ধুদের খুঁজে নিতে শুরু করে।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বিদায় দেয়ার একটি বার্তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রায় বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দেশি-বিদেশি তুমুল চাপের মুখে দৃঢ় শেখ হাসিনা এই বিচারের রায় বাস্তবায়ন শুরু করেন। ভেতরে-বাইরে সমান দৃঢ় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিজ দলের নেতারাই সমীহ করতে শুরু করেন। এক অন্যরকম কঠোর শাসক ও দলীয়প্রধানের অবয়বে আবির্ভূত হন তিনি। পদ্মা সেতুর উদ্যোগ ও এর বাস্তবায়ন, সারা দেশে আওয়ামী লীগের  জনপ্রিয়তা আরো বেশি ছড়িয়ে দেয়। বিশ্বে শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সক্ষমতা প্রশংসিত হয়।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সাথে নিয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের গুণগত সংস্কারের দিকে পা বাড়ান। আনেকাংশে সফল হন তিনি। গত দশকে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া ত্যাগীরা পুনর্বাসিত হতে শুরু করেন। ওবায়দুল কাদেরকে রানিংমেট করে দল ও সরকার পরিচালনা করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। দলীয় নানা বৃত্তে অনুপ্রবেশের আধিক্য, তৃণমূল নেতাকর্মীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে বারবার। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের বিস্তার, তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য  করে তুলেছে।

কেমন আওয়ামী লীগ চান— প্রশ্ন করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অতীতের মতো আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় থাকুক। কোনো সাম্প্রদায়িক চরিত্রের কেউ ঐতিহ্যবাহী দলটিতে যেন জায়গা না পায়।’ এ বিষয়ে ইউজিসি অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া শিক্ষক ও সাহিত্যিক ফখরুল আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময়ে সারওয়ার মুর্শেদ স্যারের মতো জ্ঞানী ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিতেন, তার পাশে থাকতেন। এখনো এই বিষয়টির অনুশীলন আওয়ামী লীগকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে পারে।