ধারাবাহিক এডিআর লঙ্ঘন

বিশেষ নির্দেশনাও মানছে না ছয় ব্যাংক

রেদওয়ানুল হক প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৩, ১২:৫৫ এএম
বিশেষ নির্দেশনাও মানছে না ছয় ব্যাংক
  • নির্দেশনা অনুসরণ করেছে পাঁচ ব্যাংক সীমা অতিক্রম  আরও পাঁচ ব্যাংকের
  • ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর সিদ্ধান্তের কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
  • কলমানি থেকে ধার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ বিতরণ কঠোর পদক্ষেপের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা (অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও বা এডিআর) মানছে না ডজনখানেক ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নির্দেশনার পরও সীমা অনুসরণ করেনি অন্তত ছয় ব্যাংক। এসব ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে এডিআর লঙ্ঘন করে আসছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ঝুঁকি বিবেচনায় গত মে মাসের মধ্যে এডিআর সীমা অনুসরণের সময় বেঁধে দিয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। পাঁচ ব্যাংক এ নির্দেশনা অনুসরণ করলেও নতুন করে আরও পাঁচটি ব্যাংক অনিয়মের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ফলে জুন শেষে এডিআর সীমা অতিক্রম করে ঋণশৃঙ্খলা হারিয়েছে ১১ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামি ধারার ব্যাংক ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে। একে ব্যাংকিং পরিভাষায় অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা বলা হয়। গত মার্চ শেষে ১১ ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা ভঙ্গের চিত্র উঠে আসে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে এডিআর লঙ্ঘন করে আসছিল। আবার কয়েকটি ব্যাংক আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। দৈনিক আমার সংবাদসহ জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে মে মাসের মধ্যে এডিআর সীমা অনুসরণের কড়া নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ছয়টি ব্যাংক এ নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। পাঁচটি ব্যাংক সীমার মধ্যে চলে এলেও নতুন করে আরও পাঁচটি ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে যেসব ব্যাংক এডিআর লঙ্ঘনের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল, এর মধ্যে ছয়টি ইসলামি এবং বাকি পাঁচটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক। এ সময়ে তিনটি ইসলামি ব্যাংকের এডিআরে সেঞ্চুরি হয়েছিল। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে তাদের আমানতের চেয়েও বেশি। সংগত কারণেই এসব ব্যাংকের তারল্য সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়। গত মার্চ শেষে যে ১১ ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার বাইরে ছিল, সেগুলো হলো—  ঢাকা, এবি, ওয়ান, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, স্ট্যান্ডার্ড, সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম, গ্লোবাল ইসলামী, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ নির্দেশনার পর জুন মাসে ঢাকা, ওয়ান, সোশ্যাল ইসলামী, এক্সিম ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ নির্ধারিত সীমায় চলে আসে। কিন্তু এবি, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, স্ট্যান্ডার্ড, গ্লোবাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নির্ধারিত সীমায় আসতে পারেনি। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি, ন্যাশনাল ও আইএফআইসি ব্যাংকের এডিআর রেশিও উল্টো বেড়েছে। আর জুন মাসে নতুন করে এডিআর সীমা লঙ্ঘন করেছে পদ্মা ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এছাড়া প্রাইম, পূবালী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামি উইং এডিআর অতিক্রম করেছে।  তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষে প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশে; মার্চ শেষে এটি ছিল ৯৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংকের এডিআর ৯০ দশমিক ২৯ শতাংশ; যা মার্চ শেষে ছিল ৮৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১০৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ; মার্চ শেষে ছিল ১০৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এ তিন ব্যাংকের এডিআর আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। এছাড়া জুন শেষে পদ্মা ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ। এবি ব্যাংকের ৯২ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং একই ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১০৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৮৭ শতাংশে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ২১ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১২২ দশমিক ৮২ শতাংশ, পূবালী ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ৯৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামি উইন্ডোর ১২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

নির্ধারিত মুখপাত্র ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য না দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ব্যাংকগুলোর উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সীমা অনুসরণ করা। কারণ ঝুঁকি পর্যালোচনা করেই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানে ব্যাংকগুলোর নিজে থেকেই সীমা মেনে চলার কথা, তখন বিশেষ নির্দেশনার পরও এডিআর অতিক্রম করার অর্থ হলো ওইসব ব্যাংক বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। কারণ তারা হয়তো ঋণ বিতরণে নিয়ম মানছে না, অথবা প্রয়োজনীয় আমানত সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের আমানতের ঝুঁকি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর পদক্ষেপ নেবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সারোয়ার হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে যেসব ব্যাংক এডিআর লঙ্ঘন করছে, তাদের ঋণ বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ তবে মে মাসের মধ্যে এডিআর সমন্বয়ের নির্দেশ দেয়ার পরও যেসব ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে, তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে— তা পরে জানানোর কথা বলেন এ কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের এ ধরনের আগ্রাসী কার্যক্রমই তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। কারণ, ১০০ টাকার আমানতের পুরোটা কোনোভাবেই ঋণ হিসেবে দেয়ার সুযোগ নেই। এই ১০০ টাকার মধ্যে সিআরআর ও এসএলআর হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হবে। এটা বাদে ঋণ দেয়ার যে সীমা নির্ধারিত আছে, সেটা যদি অতিক্রম হয়, তাহলে বাকি টাকা হয়তো মানি মার্কেট থেকে ধার করে বিতরণ করা হয়েছে। আর মানি মার্কেটের ধার করা অর্থ যদি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ হয়ে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তারল্যের অসামঞ্জস্য আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এটাই আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে প্রত্যেকটি ব্যাংকের উচিত ঋণ-শৃঙ্খলা মেনে চলা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।  

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির আগে ব্যাংক খাতে নির্ধারিত সীমায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এরপরও অনেক ব্যাংক তা সমন্বয় করতে পারেনি। সে সময় করোনার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনা ও ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০২০ সালের এপ্রিলে এডিআর দুই শতাংশ বাড়িয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ ও ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৯২ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর এ সীমায় কোনো পরিবর্তন আনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্রগুলো বলছে, এডিআর বাড়ানোর পরও সে সময় বেশ কিছু ব্যাংকের ঋণ ছিল বেঁধে দেয়া সীমার চেয়েও বেশি। করোনা মহামারির পর আগ্রাসী ঋণ বিতরণের কারণে নতুন করে কয়েকটি ব্যাংকের এডিআর সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে পুরো ব্যাংক খাতের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ৫১ শতাংশে। এর মধ্যে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর ৯১ দশমিক ০৭ শতাংশ। 

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এডিআর সীমা অতিক্রম করলে ব্যাংকের রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ভঙ্গ হয়। যার জন্য অনেক সময় জরিমানা দিতে হয়। এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে জরিমানার চিত্র দেখা যায় না। কারণ এরা ক্ষমতার প্রভাবের কারণে ছাড় পেয়ে যায়। তবে ভালো ব্যাংক এ আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সবার ক্ষেত্রে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া। যেহেতু ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত, তাই ব্যবসা করতে হলে নিয়ম মেনেই করতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ নির্দেশনার পরও কেন এডিআর অনুসরণ করা হয়নি, তা জানতে সংশ্লিষ্ট ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বারবার ফোন করা হয়। 

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনলাইন বা অফলাইন কোনো মাধ্যমেই তারা সাড়া দেননি। তবে ব্যাংকের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এবি ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা তানিয়া সাত্তার খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘এডিআর সমন্বয়ের জন্য আমরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছি। এ সময়ের মধ্যেই এডিআর সীমা অনুসরণ করা হবে।’