কে হচ্ছেন দাবার ঘুঁটি

আবদুর রহিম প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২৩, ০১:৫২ পিএম
কে হচ্ছেন দাবার ঘুঁটি
  •  টু পার্টি পলিটিক্সনির্ভর দেশে পর্দার আড়ালে হচ্ছেটা কী
  •  ভোটের রাজনীতির রেওয়াজ যে ভিন্নদিকে, তা অনেকটাই দৃশ্যমান
  • রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে গুমোট আভাস ভোট উৎসবে অনাগ্রহ
  • বহু মামলায় চাপে থেকেও হঠাৎ আলোচনায় ৮৩ বছরের নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূস
  • জনগণের অধিকার লুণ্ঠিত হয়ে থার্ড ফোর্স এলে রাজনীতিকদের ক্ষতি বলেই ভাষ্য 
  • ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানের আশঙ্কায় রাজনৈতিক ব্যক্তিতে সমঝোতার গুঞ্জন
     

দ্বাদশে গভীর রাজনৈতিক সমীকরণ। রয়েছে মানুষের বিচক্ষণ দৃষ্টি। ‘টু পার্টি’ পলিটিক্সনির্ভর দেশে পর্দার আড়ালে হচ্ছেটা কী? ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক ও নিরাপদ শব্দগুলো রাজনৈতিকপাড়ায় অধিক আলোচনায়। ডান-বামের হিসাবও তুঙ্গে। রাজনীতিতে ইসলামি আদর্শের উত্থানেরও শঙ্কা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে জনগণের অধিকার লুণ্ঠিত হয়ে থার্ড ফোর্স, নাকি রাজনৈতিক সমঝোতায় ভিন্ন কিছু— এখন এটিই যেন প্রধান খবর। যথাসময়ে নির্বাচন নিয়ে খুব ঢাকঢোল নেই। দলগুলোতেও যেন ভোট উৎসবে অনাগ্রহ। বিদেশপাড়ার সরগরমে ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যতেও গুমোট আভাস। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। 

অন্যদিকে বিএনপি বলছে, তারা ক্ষমতায় যেতে নয়, পরিবর্তন ও দেশ সংস্কারই বেশি প্রয়োজন। অজানা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে ভোটের রাজনীতির রেওয়াজ যে ভিন্নদিকে, তা অনেকটাই দৃশ্যমান। বিশেষপাড়ার খবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ের বাইরে গিয়ে বিশেষ শক্তির উত্থানের। তবে অতীতের ইয়াজউদ্দীন, ফখরুদ্দীন ও মঈনুদ্দীন, অর্থাৎ ‘তিনোদ্দীনের সরকারতিক্ততায়’ এবার রাজনৈতিক টেবিলে এখনো হয়নি মজবুত সমঝোতা— এমন ভাষ্যই রাজপাড়ার। 

সূত্রগুলো বলছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাযময়ে অতীত স্টাইলে হওয়ার অনেকটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের হ্যাটট্রিক সময় পার করার পর দ্বাদশে যুক্ত হয়েছে ভিনদেশি পাল্লা। একসময়ে নেতৃত্ব দেয়া বিএনপির প্রধান ব্যক্তিরা সাজাপ্রাপ্ত। আগামী নির্বাচনে তাদের সরাসরি ভোটের লড়াইয়ের সুযোগ অনেকটা রুদ্ধ। আবার দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়ায় তাদের আদর্শে প্রশাসনিক শক্তিবলয় বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গেলে একাদশের মতো ভরাডুবি হবে— এটা অনেকটা নিশ্চিত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এ সরকারের অধীনে  কোনো ভোট নয়। আন্দোলনের পথে হাঁটলেও সংঘাত-সহিংসতায় বিদেশিরা আগ্রহী নয়। তাদের মূল টার্গেট— যে কোনো উপায়ে সরকারের পদত্যাগ ও বিদায়। দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামিক দলগুলোর উত্থানের কারণে। ঢাকায় জামায়াতের প্রকাশ্য সমাবেশের মাধ্যমে টেস্ট কেইসে অনেক সমীকরণের ঝুড়ি যুক্ত হয়। তবে দু-একটি দেশের চরম অনাগ্রহ এ দেশে যেন ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবির্ভাব না ঘটে। এ জন্য রাজনৈতিক সমঝোতায় নেতৃত্বের কৌশলে আলাদা ফরমেটে নতুন জাল তৈরি হচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। 

রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্ভরশীল। এবার যদি রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতায় অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করে তৃতীয় শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তবে প্রথমে তার ভিকটিম হবেন রাজনীতিবিদরাই। যেমন ওয়ান-ইলেভেনের সময় তৈরি হয়েছে। কেউ যদি সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষমতায়  আসে, তাহলে তার মাধ্যমে আইন-আদালত, জনতার অধিকার বাস্তবায়নে কিছু সংস্কার যে আবশ্যক এবং ভিনদেশিদের উদ্দেশে সেটি হয়তো সম্ভব হবে না। ত্রিমুখী হিসাবের মধ্যে এখনো ঝুলে আছে দেশের অবস্থা। তবে দেশের অর্থনীতি, আইন-আদালতের ভঙ্গুর অবস্থা, মানবিক ও নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিতে রাজনীতির বাইরেও কাউকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশই বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনে যে আগ্রহী, সেটিরই বেশি মতামত পাওয়া যাচ্ছে। 

এদিকে হঠাৎ বহু মামলায় চাপে থেকেও আলোচনায় ৮৩ বছরের নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূস। তার বিষয়ে রাজনৈতিকপাড়ায় বহু কিছু চাউর হচ্ছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকরা মানিলন্ডারিংয়ের মামলাও করেছেন। এর আগে দানকর মামলায় উচ্চ আদালতেও তিনি পরাজিত হয়েছেন। আরও দুটি মামলা ঝুলে আছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে তিনি ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে পড়েছেন বলেও অনেকে মনে করছেন। দেশের ভূমিকায় তার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল নেতিবাচক। এমন পরিস্থিতিতে  ড. ইউনূসের জন্য প্রভাবশালী দেশ ও ব্যক্তিরা ইতিবাচক বক্তব্য দেয়ায় হিসাবের খাতায় ভিন্ন কিছু যুক্ত হচ্ছে বলেই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মনে করছেন। 

গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ১০০ জনেরও বেশি নোবেলবিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা একটি নতুন চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। তাতে ড. ইউনূসের বিচার স্থগিত, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখেছি, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনে প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল। উল্লেখ্য, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা, শিল্পকলা ও শিক্ষাক্ষেত্রের ৪০ বিশ্বনেতা খোলাচিঠি লিখেছিলেন। 

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতি করেন দেশের মানুষের উন্নয়ন ও শান্তির জন্য। কাজেই আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতা নিয়ে যাবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, খুব শিগগিরই দেশে পরিবর্তন আসছে। সরকারপ্রধান বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরাচ্ছেন কিন্তু কেউ কথা বলছেন না। আমেরিকা তো বিপক্ষে গেছেই; যারা উন্নত দেশ, তারাও বিপক্ষে গেছে। বর্তমান সরকারের পায়ের তলায় কোনো মাটি নেই। যাদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করে, এরাও থাকবে না। এদের পতন হবেই। এটা সময়ের ব্যাপার এবং অনেক বেশি সময় কিন্তু নেই; অল্প সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী আমার সংবাদকে বলেন, মিডিয়াতে যারা ‘তৃতীয় শক্তি’ বলে একটা শব্দ ব্যবহার করছেন, এটি ঠিক নয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে সব দলের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের ভোট প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে এ দেশে। দেশে যদি তৃতীয় শক্তি বলে কারো পরিচিতি পায়, তাহলে প্রথম শক্তি কে? রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এমন প্রশ্নও রাখেন অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী।