রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২৩, ১২:১৭ এএম
রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট
  • তিতাসের কাছে জিম্মি লাখো মানুষ 
  • গ্যাস সংকটে এলপিজি ব্যবহার করছেন অনেকে
  • গ্যাস না পেলেও মাসে গুনতে হচ্ছে এক হাজার ৮০ টাকা
  • সংকট চলছে সিএনজি পাম্পেও
  • কারখানাগুলো ধুঁকছে গ্যাস সংকটে

চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে
—হারুনুর রশীদ মোল্লাহ, এমডি, তিতাস গ্যাস

লুণ্ঠন করতেই প্রি-পেইড মিটার দিতে অনীহা তিতাসের
—এম শামসুল আলম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

মোর্শেদা বেগম। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর চারজনের সংসারের হাল ধরেন তিনি। 

সম্প্রতি বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্নার কাজে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। দুই বাসায় কাজ করেন এখন। তিনি জানান, ভোর ৬টার দিকে গ্যাসের চাপ তেমন একটা থাকে না। তাই এক বাসায় ভোর ৫টায় কাজ করতে যাই। অন্য বাসায় ৬টায়। বিদ্যুৎগতিতে কাজ করতে হয় আমাকে।

মধ্য বয়সি মোর্শেদা এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, জানি না এভাবে আর কতদিন দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। 

অন্যান্য বছর শীত মৌসুমে গ্যাসের চাপ কম থাকে। কিন্তু এবার শীত আসার এক মাস আগে থেকেই সংকট দেখা দিয়েছে। 
রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার খবর এমনই। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা বলেন, তিতাস গ্যাসের কাছে লাখ লাখ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। প্রতি মাসে গ্যাসের বিল পরিশোধ করা হলেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি মাসে পর মাস গ্যাসের চুলা জ্বালাতে না পারলেও বিল ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেক এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। মধ্যরাতে এলেও ভোরে চলে যায়। আবার মধ্যরাতে এলেও চুলা জ্বলে নিভু নিভু। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়েই অনেকে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। 

এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই পাইপলাইনের গ্যাসের পাশাপাশি এলপিজিও ব্যবহার করছেন। এতে পরিবারের খরচ বেড়েই চলেছে। একদিকে দিতে হচ্ছে তিতাসের বিল, অন্যদিকে এলপি গ্যাসের খরচ। এ অবস্থায় দ্বিগুণ ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে একদিকে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা, অন্যদিকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়েছে রান্নার জ্বালানির অতিরিক্ত খরচ। এতে রান্নার খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। 

গতকাল রোববার শনিরআখড়া, যাত্রবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, জুরাইন, মুরাদনগর, সায়েদাবাদ, মুগদা, মান্ডা, মেরাদিয়া, বাসাবোসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে তীব্র গ্যাস সংকটের কথা জানা  গেছে। 
রাজধানীর হাতিরপুল এলাকার বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, দিনের বেলায় লাইনে গ্যাস থাকে না। ভোরের দিকে হালকা আসে; সাড়ে ৭টার পর আর থাকে না। দুপুর ৩টার পর কোনোদিন হালকা গ্যাস পাওয়া যায়, কোনোদিন পাওয়া যায় না। এতে ঠিকমতো রান্নার কাজ শেষ করা যায় না।

রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় বসবাস করেন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, ভোর ৫টা থেকে ওই এলাকায় গ্যাস থাকে না। সন্ধ্যার পর হালকা আসে, যা দিয়ে ন্না করা যায় না। রাত ১০টার দিকে গ্যাসের চাপ একটু বাড়ে। এমন অবস্থায় সারাদিন রান্না করার মতো কোনো পরিস্থিতিই নেই। ফলে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছি। তিতাস গ্যাসের অসংখ্য গ্রাহক আরও জানান, তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীতে দিনের বেলায় জ্বলছে না রান্নার চুলা। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে। তখন ঘুমাব, না রান্না করব। এ সময় গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি থাকলেও  তেমন কাজে লাগছে না। শুধু রান্নার চুলা নয়, গ্যাস সংকট চলছে সিএনজি পাম্পেও। গ্যাসের জন্য পাম্পগুলোতে দেখা দিয়েছে বিশাল লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে সেখানে। রাস্তায় যানবাহনের এমন লাইনের কারণে নগরজুড়ে দেখা দিয়েছে অসহনীয় যানজট। 

কমলাপুরের এক বাড়িওয়ালা আব্দুর রহমান বাসা ভাড়া দেয়ার সময় ভাড়াটেদের আগেই বলে দেন ভোর রাতে পাইপের গ্যাস আর দিনে এলপিজি গ্যাস থাকবে। তিনি বলেন, শুধু তার বাড়িতেই নয়, পুরো এলাকার মানুষ দুই লাইনের গ্যাস বিল দিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। রাজধানীজুড়েই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেসব বাসিন্দা তিতাসের লাইনের পাশাপাশি এলপিজির সিলিন্ডার কিনছেন, তারাও এখন আর স্বস্তিতে নেই। লাইনের গ্যাস না পেলেও মাসে বিল দিতে হচ্ছে এক হাজার ৮০ টাকা করে। 

এদিকে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার, ময়মনসিংহ এলাকার কারখানাগুলো গ্যাস সংকটে ধুঁকছে। কারখানার মালিকরা বলছেন, যেসব কারখানা চালাতে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন ১৫ পিএসআই, সেখানে মিলছে ২-৩ পিএসআই। তাদের প্রশ্ন, এ অবস্থায় কারখানা চলবে কেমন করে। ফলে দিনের একটা বড় অংশ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে ঠিকই। এভাবে লোকসান দিতে হলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানায়, এ বিষয়ে অভিযোগ কেন্দ্রে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। এক মাস ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম বলে তারা অভিযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু এতে তাদের করার তেমন কিছু নেই। চাহিদা অনুযায়ী তারাও পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছেন না। তাই রেশনিং করে গ্যাস দিতে হচ্ছে। সিএনজি পাম্পে চাহিদা অনুযায়ী অর্ধেক গ্যাসও দেয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে তিন থেকে পাঁচ মিনিটে একটি গাড়িতে গ্যাস ভরা সম্ভব হতো, চাপ না থাকায় এখন সেখানে লাগছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। 

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। একসময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৪৮ কোটি ঘনফুট। দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বলেন, গ্যাসের চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।  আশা করছি শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। 

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ঋণ করে জ্বালানি কিনছে সরকার। এটি সংকট নিরসনে কোনো সমাধান হতে পারে না। দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন, গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না; কিন্তু প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। লুণ্ঠন করতেই প্রি-পেইড মিটার দিতে অনীহা দেখাচ্ছে তিতাস কর্তৃপক্ষ। প্রি-পেইড মিটার থাকলে বাড়তি বিল দিতে হতো না। 

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। তারা দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।