সহায়-সম্বল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্তবাসী

নিজ ভূখণ্ডেও অনিরাপদ

নুর মোহাম্মদ মিঠু ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪, ০১:৩২ এএম
নিজ ভূখণ্ডেও অনিরাপদ
  • সীমান্তে লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকিতে
  • আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ, খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র  
  • ঝুঁকিপূর্ণ ২৪০ পরিবারকে সরে যাওয়ার নির্দেশ জেলা প্রশাসনের
  • ২৬৮ জনের অনুপ্রবেশ নতুন ৬৫ রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক
  • মৃত্যু ও অনুপ্রবেশ নিয়ে মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ

সংঘাত মিয়ানমারে অথচ নিজস্ব ভূখণ্ডেও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বাংলাদেশ সীমান্তের মানুষ। বাড়িঘড় ছেড়ে সহায়-সম্বল নিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন স্বজনদের বাড়ি কিংবা আশপাশের গ্রামগুলোতে। টানা তিন দিন ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে চলা গৃহযুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি ও মর্টার শেল পড়ছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। হতাহত হয়েছেন বেশ কজন। গতকালও সৈয়দ আলম (৩৮) নামে আরও এক যুবক আহত হয়েছেন। যে কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পালংখালী, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং সীমান্ত এলাকাসহ বান্দরবান সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশিরা চরম আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। 

অবশ্য, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তের এক লাখের বেশি মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। হতাহতের ঘটনা, আতঙ্ক ও নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেছেন, সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ২৪০ পরিবারকে গতকাল নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশও দিয়েছেন ডিসি।

গতকাল পর্যন্ত বিজিবি সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যসহ মোট ২৬৪ জন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে। এ বিষয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সদ্য যোগদান করা বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনাও সেরকমই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘সোমবার রাত পর্যন্ত ১১৫ জন বিজিপি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও অন্য সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। 

গতকাল মঙ্গলবার সকালে আরও ১১৪ জন যোগ হয়ে ২২৯ জন ছিল। পরে দুপুরের মধ্যে আরও ৩৫ জন যোগ হয়ে বর্তমানে ২৬৪ জন আছে। এই ২৬৪ জনকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করেছি।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, নতুন করে ৬৫ জন রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। টেকনাফে বিজিবি সদস্যরা তাদের প্রতিহত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
এর আগে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজনের মৃত্যু ও সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনায় গতকাল কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার অণুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মোহাম্মদ মাইনুল কবির মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করেন এবং প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তাদের দেশের মানুষের প্রবেশ এবং সেখান থেকে গোলাবারুদ এসে পড়ার কারণে আমাদের মানুষ আহত-নিহত হওয়া এই পুরো জিনিসটি নিয়েই তাদের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।’ 

এদিকে দেশটিতে চলমান যুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ের খবর আসছে জান্তা বাহিনীর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, সীমান্ত এলাকায় পরাজিত হয়ে বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এরই মধ্যে গত তিন দিনে জান্তা বাহিনী আরও একাধিক ঘাঁটি এবং ৬২ জন সেনা হারিয়েছে। গতকাল আরও দুটি ঘাঁটি দখলে নিয়েছে বিদ্রোহীরা। সাগাইং, ম্যাগওয়ে ও মান্দালয় অঞ্চলসহ কাচিন ও কারেন রাজ্য থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের (ইএও) বিরুদ্ধে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সাগাইং শহর বর্তমানে পিডিএফ যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে জান্তা বাহিনী। 

পিডিএফ জানায়, মিয়ানমারের শাসক বাহিনী সাগাইং অঞ্চলের হোমলিনের শোয়ে পাই আই শহর পুনরুদ্ধার করার মিশন ত্যাগ করেছে। সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় গত ১০ দিন ধরে পিডিএফের সঙ্গে লড়াই করে না পেরে অবশেষে পিছু হটে জান্তা বাহিনী। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে জান্তা বাহিনীর প্রায় ৪০০ জন সদস্য এবং মিত্র শন্তি শান্নি ন্যাশনালিটিস আর্মি (এসএনএ) শহরটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। গত বছরের ২২ নভেম্বর থেকে শহরটি নিজেদের দখলে রেখেছে পিডিএফ বাহিনী। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তবর্তী স্কুলগুলো বন্ধ ও সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 

এ অবস্থায় সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের নিরাপদে আশ্রয় দিতে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে ঘুমধুমের কোনাকপাড়া, জলপাইতলি ও ভাজাবনিয়া এলাকার বাসিন্দাদের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলায় নাইক্ষ্যংছড়িতে সৈয়দ আলম (৩৮) নামে আরও এক বাংলাদেশি যুবক আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পশ্চিমকুল পাহাড়পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। 

সৈয়দ আলম ওই এলাকার কাদের হোসেনের ছেলে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আনোয়ার হোসেন বলেন, গত রাত থেকে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয়দের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে।