৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে কমল ৩ শতাংশ

জ্বালানির দাম কমানোর শোআপ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৪, ০৮:২৩ পিএম
জ্বালানির দাম কমানোর শোআপ
  • পরিবহন ও সেচ খাতে খরচ কমবে
  • জনজীবনে কোনোসুফল আসবে না
  • দীর্ঘ সময় ধরে তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে বিপিসি

দাম কমানোয় ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবে, ভোক্তা সুফল পাবে না 
—গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

স্বল্পপরিমাণে দাম কমানোয় গ্রাহক পর্যায়ে প্রভাব পড়বে না 
—এম শামসুল আলম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

বাজার তদারকির ওপর ভোক্তার সুফল নির্ভর করছে 
—মহিউদ্দিন আহমেদ, আহ্বায়ক
সাধারণ নাগরিক সমাজ


বিশ্ব বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়— প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছে ৭৫ পয়সা। পেট্রলে কমেছে তিন টাকা এবং অকটেনে কমেছে চার টাকা। আজ থেকে নতুন এই দর কার্যকর হচ্ছে। দাম কমানোর হার ডিজেল ও কেরোসিনে ০.৬৯ শতাংশ, অকটেনে ৩.০৭ শতাংশ এবং পেট্রোলে ২.৪ শতাংশ। দেশে ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। অথচ সর্বনিম্ন দাম কমেছে ডিজেলেই। 

গতকালের ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১০৯ টাকা থেকে ৭৫ পয়সা কমে ১০৮ টাকা ২৫ টাকা পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে অকটেনের দাম লিটার প্রতি ১৩০ টাকা থেকে চার টাকা কমে ১২৬ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা থেকে তিন টাকা কমে ১২২ টাকা পুনর্নিধারণ করা হয়েছে।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, আরও আগেই দাম কমানোর সুযোগ ছিল। তারা বলছেন, ডিজেলের দাম কমলে বাস ও ট্রাক মালিকদের খরচ কমবে। সেচের ব্যয়ও কমবে। অকটেন ও পেট্রোলের দাম কমলে ব্যয় কমবে গাড়ি ও মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের। যদি বাস ও ট্রাকভাড়া না কমে, তাহলে পণ্যের পরিবহন ব্যয়ও কমবে না। সাধারণ মানুষ সুফল পাবে না।

সর্বোচ্চ চার টাকা পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম কমানোতে ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত ২০২২ সালে ২৯ আগস্ট দেশের বাজারে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও কেরোসিনের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এতে খুচরা পর্যায়ে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানান সাধারণ মানুষ। 

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি মার্চের প্রথম সপ্তাহে চালু করা হবে— এ ঘোষণা আগেই দেয়া ছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন ঘোষণা করা হলো। স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে প্রথমবার দাম সমন্বয় করতে গিয়ে দেশে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কিছুটা কমবে বলে কয়েক দিন আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তবে দাম কতটা কমবে, সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি।

বিপিসির লোকসান এবং ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ। লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে করা ১৩৫ টাকা। পেট্রোল ও অকটেনের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৫১.১৬ শতাংশ ও ৫১. ৬৮ শতাংশ।

এরপর দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট এই চার ধরনের জ্বালানির দাম লিটার প্রতি পাঁচ টাকা করে কমিয়ে অকেটেন ১৩০, পেট্রোল ১২৫, ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা করা হয়। সেই দাম গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বহাল থাকে। এর আগে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র নির্ধারণ করে নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি। এতে বলা হয়— দেশে ব্যবহূত অকটেন ও পেট্রোল ব্যক্তিগত যানবাহনে বেশি ব্যবহূত হয়। তাই বাস্তবতার নিরিখে বিলাস দ্রব্য (লাক্সারি আইটেম) হিসেবে সব সময় ডিজেলের চেয়ে অকটেন ও পেট্রোলের দাম বেশি রাখা হয়।

সূত্র জানায়, অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করে সব সময়ই মুনাফা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। মূলত ডিজেলের ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। দেশে ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। দীর্ঘ সময় ধরে ডিজেল বিক্রি করেও মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বর্তমানে ডিজেল থেকে তেমন মুনাফা হচ্ছে না।

এদিকে জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহূত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহূত ফার্নেস অয়েলের দাম  ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ৩

নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। চলতি মাস থেকে ফর্মুলা অনুসারে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের আমদানি-ক্রয়মূল্যের আলোকে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য সমন্বয় করা হবে। জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্য সমন্বয় করা হয় ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট। পরবর্তী সময়ে কোভিড মহামারি-উত্তর সরবরাহ সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রপথে জ্বালানি পণ্যের প্রিমিয়াম, পরিবহন ভাড়া, বিমা এবং ব্যাংক সুদের হারও ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লিখিত সময়ে শুধু মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা অবমূল্যায়িত হয়েছে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের (প্রধানত ডিজেল) মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সরকার অটোমেশনের মাধ্যমে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের প্রথম মাসে দাম কমানোকে ইতিবাচক মনে করছেন বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ। 

মুঠোফোনে আলাপকালে আমার সংবাদকে তিনি বলেন, ‘চলতি মাসে কিছু কমেছে বটে আগামী মাসে তা আবার বাড়তেও পারে। সামন্য পরিমাণে দাম কমানোয় খুচরা পর্যায়ে এর প্রভাব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমাদের মার্কেটগুলোতে এক টাকা দাম বাড়লে খুচরা পর্যায়ে তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু কমানোর সংস্কৃতি কম। বাজার নিয়ন্ত্রণের উপর ভোক্তার সুফল নির্ভর করছে। সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মার্কেট মনিটরিংয়ের উপর নির্ভর করছে জনগণ এর সুফল পাবে কি পাবে না। সুতরাং বাজার মনিটরিংয়ে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।’  

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সংগঠক অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘দাম নির্ধারণের ফলে একটি শ্রেণি লাভবান হচ্ছে, আরেক শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অল্প পরিমাণে দাম কমানোতে এর প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হয়। এর আগেও একবার পাঁচ টাকা কমিয়েছে সরকার, যার কোনো সুফল দেখেনি জনগণ। বিশ্ববাজারে দীর্ঘদিন দাম কম ছিল তখন দাম কমানো হয়নি। এখন যৎসামান্য কমানো হয় তাও যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে পরিবহন মালিকরা এখন লাভবান হবেন।’ 

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজা করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে জানান, ‘জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি বৃদ্ধি করা যেমন অযৌক্তিক ছিল, তেমনি সামান্য কমানোও অযৌক্তিক হয়েছে। দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। এবার জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন। ভোক্তা পর্যায়ে তেমন সুফল পাবে না।