আস্থা ফিডের একক নিয়ন্ত্রণে এমবিএম আমদানি

সুমন খান প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ১২:৩১ এএম
আস্থা ফিডের একক নিয়ন্ত্রণে এমবিএম আমদানি
  • ছিল হাসিনা ও হাছান মাহমুদের দোসর

  • আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রাণিজ প্রোটিন আমদানির বাজার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয় আস্থা ফিড। আর এই আমদানির আড়ালে পাচার করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এই প্রোটিন আমদানির অজুহাতে অর্থ পাচারের পথ খুলে দিয়েছিল ওই সময়কার সরকার। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ সহ অনেকেই গত ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালালেও আস্থা ফিডের সিন্ডিকেট রয়েছে এখনো বহাল তবিয়তে। জানা গেছে প্রাণিজ প্রোটিন আমদানির বাজার এককভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য অপকৌলশের আশ্রায় নেয়া হয়েছিল।

হাসিনার আমলে সরকারিভাবে ‘হারাম’ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয় প্রাণিজ প্রোটিন বা মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল (এমবিএম)। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রাণিজ প্রোটিন আমদানির বাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় আস্থা ফিড। ফ্যাস্টিট চলে গেলেও তাদের দোসর সেই আস্থা ফিডের নিয়ন্ত্রণেই প্রোটিন আমদানি মার্কেট।

প্রাণিজ প্রোটিন বা এমবিএম নিয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, স্বৈরাচার সরকার এমবিএম আমদানি নিষিদ্ধ করে আস্থা ফিডকে দেশি-বিদেশি মার্কেট দখলের সুযোগ দেয়। এমবিএম আমদানির নামে এলসির মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ফ্যাসিস্ট প্রধান ও এমপি-মন্ত্রীরা। শুধু তাই নয়, আস্থা ফিডের মালিকপক্ষও নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে।

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০০ ভিলার খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে ২০টি ভিলার নির্মাণ ব্যয় বহন করেছেন আস্থা ফিডের ডিরেক্টর ও হাছান মাহমুদের ভাগিনা গিয়াস উদ্দিন। এছাড়াও হাসিনা থেকে শুরু অসংখ্য পলাতক নেতাদের বিদেশে পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক জোগান দেয়ার অভিযোগও উঠছে আস্থা ফিডের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, শূকরের হাড় ও মাংসের নির্যাস থেকে এমবিএম তৈরি হয় এমন অজুহাতে ২০১৮ সাল থেকে এমবিএম বা প্রাণিজ প্রোটিন আমদানি নিষিদ্ধ করে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার। এতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ব্রাজিল ও ইউরোপ থেকে বোভাইন মিল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় এ নিয়ে ধর্মের দোহাই দেয়া হয়।

যদিও মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও কমমূল্যে উন্নতমানের এমবিএম আমদানি করছে। যার ফলে সেসব দেশে মুরগি, ডিম ও মাছের দাম তুলনামূলক কম। অথচ আস্থা ফিডের মাধ্যমে আমদানি করা এমবিএম বিক্রি হচ্ছে দেদার। মাছ, মুরগিকে ঠিকই খাওয়ানো হচ্ছে মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল বা এমবিএম। কারসাজির মাধ্যমে শুধু আস্থা ফিডকে সুযোগ দিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ফলে চাহিদা থাকার পরেও পোলট্রি ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এদিকে একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে প্রোটিনের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বহু পোলট্রি ব্যবসায়ী লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। যার প্রভাবে মাছ, মুরগি ও ডিমের দাম প্রায় সময়ই ঊর্ধ্বমুখী থাকে।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে প্রতি বছর বোভাইন মিলের চাহিদা ৪২ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ২৪০ মিলিয়ন ডলার (২৯০ কোটি টাকার বেশি)। দেশের সব আমদানিকারকরা আমদানি করতে পারলে এই চাহিদা যেমন সহজেই মেটানো যেতো, তেমনি বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব কয়েকগুণ কমে যেত।

আমদানিকারকদের একজন নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানান, সাবেক সেনাপ্রধান শফিউদ্দিনের আত্মীয় ও হাছান মাহমুদের ভাগিনা গিয়াসউদ্দিনের ব্যবসায়িক সহযোগী মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকেই এমবিএম আমদানিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে আস্থা ফিড। অন্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকেও এখন আস্থা ফিডের অনুমতিপত্র দেখিয়ে এমবিএম বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, রপ্তানিকারক দেশেও তাদের অনুমতিপত্র দেখাতে হচ্ছে। এমবিএম আমদানি বা রপ্তানি কোনোটাই আস্থা ফিডের অনুমতি ছাড়া সম্ভব না। গত সাত বছর ধরে ক্ষমতার কাছে কোণঠাসা ব্যবসায়ীরা।

অথচ অভিযোগ রয়েছে, আস্থা ফিড শুল্কমুক্ত সুবিধায় নামমাত্র ভ্যাট দিয়ে কারখানার নামে এমবিএম আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আমদানিকারক যদি বিদেশ থেকে ট্যাক্স সুবিধা নিয়ে র-মেটারিয়ালস আমদানি করে বন্ডেড ওয়ার হাউজে না রেখে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন তাহলে এটা অপরাধ। যদি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আমদানি করেন সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

জানা গেছে, এমবিএম আমদানির আড়ালে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী দুবাই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বিপুল টাকা বেনামি বিনিয়োগ করেছেন। এই বিনিয়োগের বৈধ কোনো উৎসও নেই। এমনকি তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামেও দুবাইতে ওয়েসিস ওভারসিস ও ইব্রাতাস ট্রেডিং কোম্পানি নামে একাধিক কোম্পানি খুলেছেন। তার বোনের নামেও রয়েছে একাধিক কোম্পানি। ইতোমধ্যে তিনি দেশ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা দুবাইতে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আমদানিকারকদের দাবি, এমবিএমের জন্য সরকারের যতগুলো সার্টিফিকেশন থাকার দরকার আমরা তার সবগুলোই দিতে চেয়েছি। যেসব দেশ এমবিএম তৈরিতে কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করে তাদের থেকে আনলে কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু তাতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাড়া মেলেনি।

তারা বলছেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ থেকে বোভাইন প্রোটিন আমদানির কারণে ব্যবসা কমে গেছে। পাশাপাশি একচেটিয়া আধিপত্য ও বিশেষ সুবিধা আদায়ের ফলে বছরে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বড় রাজস্ব বঞ্চিত সরকার।

ব্যবসায়ীরা বলেন, এমবিএম আমদানি কিছু লোকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর তাদের মাধ্যমে সৌদি আরব ও দুবাইয়ের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। তারা কিছুতেই চায় না এমবিএম ফিরে আসুক। হজে গেলে দেশের মানুষ আল ওতারির মুরগি খায় কীভাবে? তারাও তো বোভাইন মিল ব্যবহার করে। কিন্তু পতিত সরকার বাজার সংকুচিত করে দিয়ে গেছে। আমাদের দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের ওখানে বিনিয়োগ করে রেখেছে। যে কারণে তারা আর অন্য কাউকে সেখানে ব্যবসা করার সুযোগ দিচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০১৮-১৯ সালের দিকে আস্থা ফিডের চেয়ারম্যান মোশাররফ গবাদিপশু ও মাছের প্রোটিন আমদানির ক্ষেত্রে ধর্মকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। যদিও মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তান এবং ব্রাজিল থেকে হালাল এমবিএম আমদানি করে আসছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও ব্যবসায় নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সাবেক সেনাপ্রধানের আত্মীয় পরিচয়ে, আস্থা ফিডের মোশাররফ ও গিয়াসউদ্দীন সরকারের উচ্চ মহলকে ম্যানেজ করে ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা নন বোনমিলকে ‘হারাম’ ঘোষণা দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

আমদানি সংশ্লিষ্টদের মতে, যেসব কোম্পানি ব্রাজিল ও জার্মানসহ উন্নত কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করতেন তারাও এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। বিষয়টি অনেকটা ব্রিটিশ আমলে এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার নিয়ে মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে যেমন মতভেদ তৈরি হয়েছে। ঠিক তেমন প্রেক্ষাপট তৈরি করে বাংলাদেশ এমবিএম আমদানি বন্ধ করে। যদি এমবিএম আমদানি করা যায় তাহলে প্রতি কেজিতে প্রায় ২ টাকা কমে যেত। এতে বাজারে পোলট্রি মুরগি, ডিম ও মাছের দাম কমে যাবে।

এ ব্যাপারে মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল ইন্ডাস্ট্রিজের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শূকরের মাংস মিশ্রিত হাড় ও বোন এবং গরুর মাংস মিশ্রিত হাড় ও বোন বোভাইন মিল বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে মুরগি নাপাক খায় এই অজুহাতে বোভাইন মিল আমদানি বন্ধ করা হয়। যা অযৌক্তিক। দেশে বোভাইন মিল আমদানি করা হলে ডিম, মুরগি ও মাছের দাম কমবে।’

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব বছরে ৫০ হাজার টন বোভাইন মিল আমদানি করে, আরব আমিরাতও প্রায় একই পরিমাণ মিটেন বোন আমদানি করে। এতে কী তাদের ধর্ম-কর্ম সব চলে গেল? কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এটা করা হবে না। ২০১৮ সালে সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কেউ বোভাইন মিল আমদানি বন্ধ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারি দপ্তরের কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চায় না। ওনারা বারবারই মুরগিকে ‘মুসলমান’ বানানোর কাজ করছেন।’

এসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মিট অ্যান্ড বোভাইন মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশি মুরগি ঘুরে ঘুরে যে খাবার খায় সেটা কি হালাল? মুরগি হালাল খাবে না হারাম খাবে সেটা কীভাবে ঠিক করবেন? বাণিজ্যনীতিও এমবিএম বিপক্ষে না। অতিরিক্ত সচিব ওয়াসি উদ্দিন আহমেদ শূকরের মাংসের কারণে এমবিএম আমদানি বন্ধ করেন দেন। যদিও বাণিজ্যনীতিতে এমনটি বলা নেই।’

তিনি বলেন, ওই সময় আমরা বিষয়টি মেনে নিয়েছি। শূকর বাদে এমবিএম আমদানি করব। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যদি শুকরের একটি কনাও আসে সেটা টেস্টে ধরা পড়বে। কিন্তু এটাকে ধর্মীয় বিষয় বানিয়ে ফেলেছে একটি চক্র। কয়েকজনের লোকে হাতে এমবিএম জিম্মি হয়ে আছে। তাদের মাধ্যমে সৌদি আরব ও দুবাইয়ে ব্যবসা চলে গেছে। তারা কিছুতেই চায় না এমবিএম ফিরে আসুক। এমবিএম আমদানিতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে আমি অবগত নই। এটা নিষিদ্ধ আছে, এটুকু জানি। আমি ডিজির চেয়ারে বসেছি তিন মাস হলো। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেই ভালো হবে।’

তবে এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হলেও তারা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

জানতে চেয়ে আস্থা ফিডের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।