ঈদের লম্বা ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি শিপমেন্টের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। ছুটির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি ডেলিভারি কমেছে। আর শ্রমিক সংকটের কারণে জাহাজে কনটেইনার ওঠানামায়ও সময় বেশি লাগছে। ফলে ধস নেমেছে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে।
একই কারণে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) থেকেও সঠিক সময়ে রপ্তানি পণ্য বন্দরে না আসায় রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজে ওঠানো যায়নি। ফলে রপ্তানি শিপমেন্টের শিডিউল প্রায় ৩০ শতাংশ বিপর্যয় ঘটেছে। ব্যবসায়ী এবং বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঈদের লম্বা ছুটিতে আমদানি পণ্য খালাস এবং বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ কমে যাওয়ায় বহির্নোঙরে বেড়েছে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা।
যদিও ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমসের যৌথ সভায় বন্দর সচল রাখতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে তা সুফল বয়ে আনেনি। বরং বন্দরের বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বেড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঈদের ১০ দিন ছুটির সময়ের স্টোরেজ ভাড়া মওকুফের দাবি জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ঈদের ছুটিতে গত ৯ জুন পর্যন্ত অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়ে ৩৫টিতে দাঁড়ায়। তার মধ্যে ২৪টিই কনটেইনার জাহাজ। তার আগে গত ৪ জুন ১৭টি কনটেইনার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আমদানি পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষায় ছিল। একই সময় স্ক্র্যাপসহ অন্যান্য আমদানি পণ্য নিয়ে আরও ৯টি জাহাজ অপেক্ষায় ছিল। স্বাভাবিক সময়ে কনটেইনারসহ বিভিন্ন ধরনের ২৫ থেকে ২৬টি জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ থাকলেও ঈদের ছুটিতে বেড়েছে ওই সংখ্যা। গত ৮ জুন বন্দরের ১২টি কনটেইনার জেটির মধ্যে মাত্র ৫টি জেটিতে থাকা কনটেইনার জাহাজে কাজ হয়েছে।
ওইদিন বন্দর থেকে মাত্র ১৩১টি কনটেইনার জাহাজীকরণ হয়। একই সময়ে জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যভর্তি মাত্র ৩০৮টি কনটেইনার খালাস হয়। মূলত জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কমে যাওয়ায় বাড়ছে বন্দরের বহির্নোঙরে ওয়ার্কেবল অপেক্ষমাণ জাহাজ। ১০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ওয়ার্কেবল অপেক্ষমাণ ৫৩টি জাহাজ রয়েছে। তার মধ্যে কনটেইনার জাহাজ ১৬টি, জেনারেল কার্গো জাহাজ ১৫টি, ফুড গ্রেইন বোঝাই জাহাজ ৬টি, ক্লিংকারবাহী জাহাজ ২টি এবং অয়েল ট্যাঙ্কার ৭টি।
সূত্র আরও জানায়, অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে ঈদের ছুটিতে কনটেইনার ডেলিভারি। ৫ জুন বন্দরে ৪ হাজার ১২২ টিইইউস (বিশ-ফুট সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল। ওইদিন জাহাজে ৯ হাজার ৭২০ টিইইউস কনটেইনার ওঠানামা বা হ্যান্ডলিং হয়েছিল আর আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে ৫ হাজার ৪১১ টিইইউস নামানো হয়েছিল। কিন্তু বন্দরে কমতে থাকে ডেলিভারির সংখ্যা। ৬ জুন ৩ হাজার ৫০৫ টিইইউস, ৭ জুন ৫২১ টিইইউস, ৮ জুন শূন্য টিইইউস, ৯ জুন ৪৩৭ টিইইউস ও ১০ জুন ১ হাজার ৩৮১ টিইইউস কনটেইনার ডেলিভারি করা হয়েছে। আর স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ থেকে নামানো হয় প্রায় ৫ হাজার আমদানি কনটেইনার।
কিন্তু ৬ জুন ৫ হাজার ৫৪৪ টিইইউস, ৭ জুন ২ হাজার ৮৩৫ টিইইউস, ৮ জুন ৩০৮ টিইইউস, ৯ জুন ২ হাজার ১১৩ টিইইউস ও ১০ জুন জাহাজ থেকে ২ হাজার ৩১১ টিইইউস আমদানি কনটেইনার নামানো হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮টি কনটেইনার, যার সর্বোত্তম পরিচালনা ক্ষমতা ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টিইইউস। ১০ জুন পর্যন্ত বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার ছিল ৩৮ হাজার ৫২ টিইইউস। আর বুধবার পর্যন্ত বন্দরে ৪০ হাজার ৬৬১ টিইইউস কনটেইনার ছিল।
এদিকে বন্দর সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ টিইইউস রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে তোলা হয়। কিন্তু ঈদের ছুটিতে শ্রমিক সংকটের কারণে কনটেইনার বোঝাই করা যায়নি। ফলে অন্তত ৩০ শতাংশ রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে সঠিক সময়ে তোলা যায়নি। আর জাহাজে পণ্য লোড ও আনলোড করার সময়ও বেড়েছে। বন্দর জেটিতে জাহাজ প্রবেশ করে কনটেইনার লোড-আনলোড করতে সময় লাগে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা। ঈদের ছুটিতে শ্রমিক কমে যাওয়ায় ও কনটেইনার জট তৈরি হওয়ায় এখন সময় লাগছে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা। জাহাজে পণ্য ওঠানামায় বিলম্বের কারণে একদিন বেশি সময়ের জন্য জাহাজের আকারভেদে ১৫ হাজার ডলার থেকে ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হবে। ওই বাড়তি খরচ পণ্যের মূল্যে যুক্ত হবে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ১০ মার্চ থেকে বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বাড়িয়েছে। জাহাজ থেকে নামানোর পর ৪ দিনের বেশি বন্দরে থাকা কনটেইনারের ক্ষেত্রে এ বর্ধিত চার্জ প্রযোজ্য হয়। রমজান মাসে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট রোধ করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তারপর থেকে স্টেকহোল্ডাররা ওই চার্জ বাতিলের দাবি জানিয়ে এলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি।
এ প্রসঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আব্দুল্লাহ জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা একটু বেশি। সাধারণত দিনে ১০ থেকে ১৫টি জাহাজ চলে এলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে এখন বহির্নোঙরে জাহাজের যে সংখ্যা, তা নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। যে ফ্লোতে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হচ্ছে তাতে জট তৈরির সুযোগও কম। কয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।