- বাসিন্দাদের তেহরান খালি করে চলে যেতে বলেছেন ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত সোমবার রাতের একটি মন্তব্য ঘিরে ইরানের তেহরানজুড়ে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি অবিলম্বে বাসিন্দাদের শহরটি খালি করে চলে যেতে বলেছেন।
ট্রাম্পের এমন মন্তব্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইরান-ইসরাইল সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে কি না। তেহরান নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা কী সেটি নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, শুক্রবার ইসরাইলের হামলাগুলো ছিল ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনার ওপর প্রথম প্রকাশ্য হামলা।
যদিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর চূড়ান্ত প্রভাব কী হবে এখনও স্পষ্ট নয়, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র নাতানজ এই হামলায় ধ্বংস হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অন্য প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা হয়নি।
তবে পরে গ্রোসি জানান, ‘ইরানি কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে আরও দুটি স্থাপনায় হামলার কথা, ফোরদো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ইস্পাহানে।’
হামলায় ইরানের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয়জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলো রক্ষার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এখনও তার অনেক দক্ষতা ও যন্ত্রপাতি ধরে রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে হলে কেবল বিমান হামলাই নয়, সাইবার যুদ্ধ, গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সম্ভাব্যভাবে স্থল বাহিনীর একটি ধারাবাহিক অভিযান প্রয়োজন হবে। তবুও পাহাড়ের প্রায় অর্ধ মাইল গভীরে অবস্থিত ফোরদো স্থাপনাটি হয়তো ইসরাইলের বর্তমান অস্ত্রশস্ত্রের আওতার বাইরে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও স্কোক্রফট মিডল ইস্ট সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের পরিচালক জোনাথন পানিকফ টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই সবচেয়ে উন্নত ধরনের বাংকার-ধ্বংসকারী বোমা রয়েছে, যা এমন স্থাপনায় প্রবেশ করে কার্যকরভাবে আঘাত করতে সক্ষম।’ ফোরদো পরমাণু স্থাপনাটি ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাঁচ দিন ধরে চলা ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে সবচেয়ে বড় মূল্য চুকাতে হচ্ছে মূলত তেহরান ও তেল আবিবের বাসিন্দাদের। ইতোমধ্যে ইরান যুদ্ধে ২২৪ জন নিহতের কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে ২৪ জনের প্রাণহানির কথা জানিয়েছে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধে বৈশ্বিক চাপ বাড়ছে।
আশা করা হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসবেন। তবে সোমবারে ট্রাম্পের মন্তব্য ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কানাডায় জি-৭ সম্মেলনে অংশ নেয়ার পর একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো বলেন, ‘ট্রাম্পের জি-৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগে চলে যাওয়া ইতিবাচক, কারণ এখন মূল লক্ষ্য হলো ইসরাইল ও ইরানকে একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব করেছে।
ম্যাক্রো সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে যুদ্ধবিরতির জন্য এবং আরও বিস্তৃত আলোচনার সূচনা করার জন্য। আমি মনে করি এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। এখন দেখা যাক সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কী করে।’
তবে ট্রাম্প অস্বীকার করেন যে তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য জি-৭ সম্মেলন ছেড়েছেন। তিনি এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য ম্যাক্রোকে দায়ী করেন। যদিও এই ‘বড় কিছু’ কী হতে যাচ্ছে- সে বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে এই পোস্টের মাধ্যমে শিগগিরই যুদ্ধবিরতির প্রত্যাশা ভেঙে পড়েছে। ইরানকে কার্যত হুমকিই দিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘তেহরানবাসীরা যেন দ্রুত তাদের শহর ছাড়ে। ইরান কখনোই পরমাণু অস্ত্র রাখতে পারবে না।’ এরই মধ্যে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন ট্রাম্প। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আলবার্টা ছেড়ে ওয়াশিংটনের পথ ধরেছেন।
এদিকে ইসরাইলপন্থি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১৪ জানিয়েছে, ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ইসরাইলের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন প্রশাসন প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঙ্গলবারেও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সত্যিকারের সমাপ্তি চান। দেশটিকে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কর্মসূচি পুরোপুরি ত্যাগের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বলিনি যে, আমি যুদ্ধবিরতি চাইছি। পরের দুইদিনে কী ঘটে সেটা দেখবেন আপনারা। আপনারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। কেউই এতদূর দেখায়নি।’
তেহরানের এক কোটি মানুষকে শহর ছাড়তে বলার পর নতুন করে এই হুমকি দিলেন তিনি। এদিকে ইসরাইলও সোমবার তেহরানের ৩০ লাখ বাসিন্দাকে শহর ছাড়ার সতর্কবার্তা দিয়েছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসূটি ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে যোগ দেবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন, তিনি আশা করেছিলেন আরও আগেই যেন এটি ‘মুছে যায়’। ইরানে হামলার বৈধতা তৈরিতে বারবার দেশটির পরমাণু কর্মসূচির অজুহাত দিয়েছে ইসরাইল।
তবে কয়েকমাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড একটি প্রতিবেদন জানান, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। এমনকি ২০০৩ সালে পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করার পরও ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা খোমেইনিও এতে নতুন করে অনুমোদন দেননি। বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সে (তুলসি) কী বলেছে তাতে আমার যায় আসে না।
আমি মনে করি, পরমাণু অস্ত্র পাওয়ার বিষয়ে তারা খুব কাছাকাছি ছিল।’ ইসরাইলের প্রধামন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি স্পষ্ট করেছেন, তারা ইরানে হামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরমাণু কর্মসূচিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবেন।