প্রতিনিয়ত দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে গ্যাসের জোগান কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। অন্যদিকে স্থলভাগের ৫০ ভাগ গ্যাস ব্লক খালি পড়ে রয়েছে।
উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) হালনাগাদ না করায় নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের পর স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি আর হালনাগাদ করা হয়নি। পিএসসি হালনাগাদ করতে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর উড ম্যাকেঞ্জিকে নিয়োগ দেয়া হয়।
কয়েক দফা চেষ্টার পর বিদেশি কোনো কোম্পানি থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চেষ্টা আপাতত বাদ দিয়েছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত গ্যাসের জোগান বাড়াতে স্থলভাগে অনুসন্ধান জোরদারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমে দেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই সম্ভাবনাময় স্থলভাগে গ্যাসের অনুসন্ধান করা হবে। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সাগরে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধানে চরম ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। নানা চেষ্টা করেও বিদেশি নির্ভরযোগ্য কোনো কোম্পানিকে আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। অথচ প্রায় এক যুগ হয়ে গেছে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির।
তিনি বলেন, সর্বশেষ টেন্ডারে কয়েকটি ভালো কোম্পানি দরপ্রস্তাব গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা আগ্রহ না দেখানোয় হতাশ পেট্রোবাংলা। এ অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম রেখে দিয়ে আপাতত স্থলভাগে অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানো হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পেট্রোবাংলা থেকে স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব শিগগিরই আসবে জ্বালানি বিভাগে। এই প্রস্তাব ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত হলেই স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেশের বিদ্যমান উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায় স্থলভাগে কাজ দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে গ্যাসের দাম পরিবর্তনসহ কিছু বিষয়ে পিএসসিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জি এই পিএসসি চূড়ান্ত করেছে। ম্যাকেঞ্জির প্রণীত পিএসসিতে জ্বালানি বিভাগের গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি বেশকিছু সংশোধন ও সুপারিশ করেছে। সেটা আবার চূড়ান্ত করে পেট্রোবাংলা জ্বালানি বিভাগে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি প্রায় চূড়ান্ত। দ্রুতই মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎপাদন কমছে। ফলে আমরা স্থলভাগে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম দ্রুত করতে চাই। কারণ সমুদ্রে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া কয়েক দফা চেষ্টার পরও বিদেশিরা আগ্রহী না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা তৈরি করেছে। আরও সময় নিয়ে এই বিষয়টি ভাববে সরকার।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের মোট উৎপাদন ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন গ্যাস উত্তোলন করছে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। আর তিনটি দেশীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানির উৎপাদন প্রতিদিন গড়ে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। চাহিদার বাকি গ্যাস বিদেশ থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাসের জোগান ঠিক রাখতে দেশীয় উৎস থেকে জোগান বাড়াতে হবে। তা না হলে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে। তবে দেশে এখন এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ বৃদ্ধির মতো অবকাঠামো নাই। একই সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টিও সহজ নয়। ফলে জ্বালানি বিভাগ স্থলভাগে অনুসন্ধানে জোর দিতে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া নিয়ে সর্বশেষ গত সোমবার পেট্রোবাংলায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে শেভরন, তাল্লো এবং অন্য গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়।
এদিকে সামগ্রিক বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানির জোগান এবং সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এক যুগেও সমুদ্র ব্লকগুলো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা সবচেয়ে বাজে উদাহরণ। স্থলভাগ নিয়ে আশা থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হয়, ততদিন হতাশাই থেকে যাবে।
তিনি বলেন, সমুদ্র ব্লকগুলো ইজারার বিষয়টিতে শুধু অর্থনৈতিক না ভৌগোলিক রাজনীতির বিষয়ও আছে। ফলে এটা রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা বিবেচনায় এখন একমাত্র সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো স্থলভাগ। কম সময়ে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় এ সুযোগই কাজে লাগতে চায় সরকার। দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোও দরপত্রে অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশের স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। খালি থাকা ব্লকগুলো হচ্ছে- ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি ও ২৩ নম্বর। এসব ব্লকে কাজ করতে অভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করছে পেট্রোবাংলা। সেই সঙ্গে স্থলভাগের গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে। ২২এ এবং ২২বি ব্লকগুলো মূলত পাহাড়ি এলাকা।