Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

পরিবারতন্ত্রের বৃত্তে বন্দি রাজনীতি!

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬, ০৫:৩৩ এএম


পরিবারতন্ত্রের বৃত্তে বন্দি রাজনীতি!

বাংলাদেশের গণতন্ত্র মূলত পরিবারতন্ত্রের রাজনীতিতে হাঁটছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের এ দেশে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিবারতন্ত্র নিয়ে হরহামেশাই বাস, লঞ্চ, ট্রেন আর হাটে-মাঠে আলোচনা চলছে। আলোচকদের মতে প্রায় ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশে চলছে পরিবারতন্ত্রের প্যাকেটে মোড়ানো উদ্ভট এক গণতন্ত্র। বিশেষ করে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টিকে নিয়েই এমন অভিযোগ সবথেকে বেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে বিভিন্নজন নানাভাবে নানাজন এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এবং অনেকে এর আমূল পরিবর্তনও চেয়েছেন। দুর্বল কিছু বাম সংগঠন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তির ক্ষীণ কণ্ঠে বিষয়টি উচ্চারিত হলেও দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অনীহা ও অবহেলার কারণে এ ব্যাপারে কার্যকর কিছু করা সম্ভব হয়নি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, দেশের রাজনীতিতে আপাতদৃষ্টিতে পরিবারতন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে যোগ্যতাবলে কেউ যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বে চলে আসেন তাহলে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতৃত্বের হঠাৎ আবির্ভাবে পরিবারতন্ত্র নেই বলে আমার মনে হচ্ছে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ ব্যাপারে বলেন, আমরা গণতন্ত্রের দোহাই দিই, কিন্তু গণতান্ত্রিক হই না। যদি হতাম তবে বস্তুতই গৃহবন্দি হত না দেশের গণতন্ত্র, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা। রাজনীতিতে স্থান পেত না অসহনশীলতা ও অসহিষ্ণুতা। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে সমর্থন আদায় হত না দলীয়নীতির কৌশল। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তারও হত না। জন.এফ.কেনেডির সেই সু-বিখ্যাত উক্তিটির বিপরীত ফল লাভের জন্য আমাদের নেতানেত্রীরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। এটাই হলো আমাদের দেশে দলবাজির মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় গেলে কি পাওয়া যায় সেই আশায় আমাদের দেশে অনেকেই দলে সম্পৃক্ত হন। অথচ তাদের মধ্যে না থাকে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি-আদর্শ, না থাকে কোনো রাজনৈতিক সচেতনতা। তাই কাগজে-কলমে যেটুকু গণতন্ত্র বড় রাজনৈতিক দলে ও দেশে আছে তা বস্তুত ১৩ থেকে ১৭শ’ শতাব্দীর সুলতানী ও মোঘল আমলের পারিবারিক একনায়কতন্ত্রেরই প্রেতাত্মা, তারই আধুনিক রূপ। এই সত্য আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদ এ ব্যাপারে বলেন, দলীয় প্রধানের আপনজনদের কেউ যদি যোগ্যতা বলে রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেন তাহলে পরিবারতন্ত্র বলা যায় না। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র করা হলে মূল দল ও অঙ্গ সংগঠনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় প্রধানের আপনজনদের বসানো হতো। যারা দলে আছেন তারা আমার জানামতে নিজ যোগ্যতাবলেই আছেন। তবে যাদের দলই রাজনৈতিকভাবে গঠিত হয়নি সে সব দলের মধ্যে পরিবারতন্ত্র থাকলেও থাকতে পারে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, মাত্র তিনটি পরিবারের মধ্যে হাতবদল হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা। এসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের অগণন মানুষের ভাগ্য। গত ৩৬ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন এ দেশের রাজনীতিকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার খেলায় এ পরিবারগুলোর ভূমিকাই প্রধান।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এ ব্যাপারে বলেন, পরিবারের লোকজনকে দলের নেতৃত্বে আনাটা দোষের কিছু নয়। এটা সব দেশেই হচ্ছে। আমেরিকায় বুশ পরিবারের লোকজনকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এনেছেন, জিমি কার্টারও একই কাজ করেছেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কাতেও এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। এভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই পরিবারের লোকজনকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আনা হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৮১ থেকে আওয়ামী লীগের হাল ধরে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। হাসিনা রাজনীতিতে থাকতেই উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধু-দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম, যদিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি এখনও সক্রিয় নন। গত ৩৬ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারে যারা প্রথম কাতারে ছিলেন, তারা হলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাই মরহুম শেখ নাসেরের পুত্র শেখ হেলাল, বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ ও তার ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি ও তার ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তারা দুজনই শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। শেখ হাসিনার দূর সম্পর্কের ফুফা আমীর হোসেন আমু ও দূর সম্পর্কে ফুফু দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজেদা চৌধুরী, দূর সম্পর্কে চাচতো ভাই বাহাউদ্দিন নাসিম। বঙ্গবন্ধুর দূর সম্পর্কের ভাগ্নে নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন, শেখ শহীদুল ইসলাম, শেখ হাসিনার ফুফা লে. জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান (বীর বিক্রম), বেয়াই ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজনীতিতে যুক্ত আছেন।

অপরদিকে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠিত হলেও বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন ১৯৮২ সালে। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অত্মীয়-স্বজন রাজনীতিতে ছিলেন না। স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের প্রায় ৫ জন সদস্য রাজনীতিতে যুক্ত। এর মধ্যে বড় ছেলে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছোট ভাই প্রয়াত মেজর (অব.) সাঈদ ইস্কান্দার, নীলফামারী বিএনপি’র সভাপতি ও আপন বড় বোনের ছেলে প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম তুহিন এবং বোন প্রয়াত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের পাশাপাশি স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জি এম কাদের, বোন মেরিনা রহমান রাজনীতিতে অবস্থান শক্তিশালী করেছেন। ভগ্নিপতি প্রয়াত ড. আসাদুর রহমান ও জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বিদিশাকে বিয়ে করার পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, রাজনীতিতে কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারেন না, আর সে সুযোগও নেই। যোগ্যতাবলেই অবস্থান গঠিত হয়। কেউ হঠাৎ করেই রাজনীতিতে আসতে পারেন না। আর যোগ্যতাবলে যদি কেউ রাজনৈতিক পদ পায় সেটাতে আমি দোষের কিছু দেখছি না। এটাকে আপনারা যদি পরিবারতন্ত্র বলেন সেটা আপনাদের বিবেচনা। পরিবারের লোকজন রাজনীতিতে আসা বা থাকা এটা শুধু আমাদের দেশেই নয় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এভাবে আছে এবং থাকবে। তিনি বলেন, পরিবারতন্ত্র বিষয় নয়, এটা আছে এবং থাকবে। তবে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকারসহ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত আছে কিনা সেটাই দেখার ও ভাবার বিষয়। এটাকেই আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে সবার কাজ করা উচিৎ। বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আব্দুল মান্নান বলেন “বাংলাদেশে আজ সত্যিকার গণতন্ত্রের অভাব। গণতন্ত্র নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এই দুটি দলই সরকারে বার বার ছিল, বিরোধী দলেও বার বার ছিল। কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কেউই চেষ্টা করেননি। তিনি বলেন, “আজকে গণতন্ত্রের চরম বিপর্যয়ের জন্য আমি এই দুটি দলকেই দায়ী করব। কারণ তারা পারিবারিক শাসনে বিশ্বাস করে, জনগণের শাসনে বিশ্বাস করে না। সেজন্যই গণতন্ত্রের আজ এই দুর্দশা।”

রাজনীতির বিবর্ণ চেহারার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহকেই দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনীতিকে প্রয়োজনীয় ও কাক্সিক্ষত অবস্থানে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে শোধন প্রয়োজন সর্বাগ্রে। আর দলসমূহের স্খলনের জন্য দায়ী দলের নেতৃত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে দেশ শাসন করেছে। তিনটি দলেই গণতন্ত্র চর্চার অভাব, স্বৈর মানসিকতা আর কর্তৃত্ববাদের প্রবণতার কথা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিযোগ।

দেশের প্রধান দুটি দল ছাড়াও পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত ও ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া নেতাদের দলেও পরিবারের লোকদের রাজনীতিতে নিয়ে আসার এবং উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়ার প্রবণতা আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ নিজের স্ত্রী ও ভাইকে এবং তরুণী দ্বিতীয় স্ত্রীকেও দলের উচ্চপদে এনেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল বিকল্প ধারার সূচনা হয়েছে পিতা-পুত্রের নেতৃত্ব।

শতফুল ফুটতে দাও-এটা কেবল গণতন্ত্র, কেবল গণতন্ত্রকেই নিশ্চয়তা দিতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের বহু অনুন্নত দেশের বঞ্চিত মানুষের অংশীদারিত্বমূলক শাসনের আকাক্সক্ষার শেষ ভরসা গণতন্ত্র। গণতন্ত্র অবাধ হোক, মুক্ত হোক, অংশীদারিত্বমূলক হোক- এটা আজ সবার নাগরিক প্রত্যাশা।