Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

‘হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে; সেটা মুজিব জানতেন’

আগস্ট ১৫, ২০২১, ০১:৪০ পিএম


‘হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে; সেটা মুজিব জানতেন’

ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ও জাতির জনক হলেন শোকার্নো। তিনি ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৬৭ অবধি ক্ষমতায় ছিলেন। কারো কাছে তিনি নায়ক আবার কারো কাছে ছিলেন ভিলেন। এসব কথা থাক। যেটা বলতে চাচ্ছি, তাকে সে দেশের ৬ জন উচ্চ-পদস্থ আর্মি অফিসার কিডন্যাফ করে এবং একটি প্রসাদে আটকে রাখে। 

অফিসারদের ভাষ্যমতে তারা শোকার্নোকে বন্দি করে দেশের মানুষকে মুক্তি দেন। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ সহ বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য খুনিদের ও একই পয়েন্ট অফ ভিউ ছিল। তারা বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেবার জন্যে মুজিবকে হত্যা ছাড়া অন্য কোন পথ খুঁজে পাননি।

বঙ্গবন্ধুকে মারার পরিকল্পনার আগে মেজর ফারুক (বেঙ্গল ল্যান্সার্স এর উপ-অধিনায়ক, মুজিব হত্যার কৌশল গত নকশা তৈরীর কারিগর) কয়েক ডজন বই পড়লেন। সে তালিকায় ছিল চেগুয়েভেরার ডায়েরী, চিনের মাও সেতুং এর কিছু বই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু থিসিস। 

কিন্তু মার্কসবাদী চিন্তা ধারা তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি, তার কাছে সমাধান মনে হয়নি। বাংলাদেশের অবস্থার সঙ্গে কোনো বইয়ের তিনি মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঠিক সেই সময় ফারুক শোকার্নো উৎখাতের পরিকল্পনার কিছু কিছু রচনা পড়েন এবং মুজিব হত্যার কৌশলগত পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেন।

বেশ কিছু পরিকল্পনা ছিল এটেছিলেন। তিনি মুজিবকে শোকার্নোর মত বন্দী করে রাখারও পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ভেবে দেখলেন তাতে ঘোরতর বিপদ। কারণ, তাদের পক্ষে পুরো সেনাবাহিনী কিংবা দেশের সব মানুষ নাই। তারা সংখ্যায় ছিল খুবই নগন্য। তারা দেখল, প্রথমত মুজিবকে বন্দী করলে সেনাবাহিনী থেকে তাদের সড়িয়ে দেওয়া হত। 

দ্বিতীয়ত, ভারত প্রতিবাদ করত। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী প্রেরণ করত। তখন মুজিবকে মেরে ফেললেও কোনো ফায়দা হত না। দেশটা ভারতের হাতে চলে যেত। তৃতীয়ত, মুজিবের রক্ষীবাহিনী সব কিছু তছনছ করে দিত। তাই মুজিবকে শোকার্তের মত বন্দী করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিলেন।

তারপর ভাবলেন মুজিব যেহেতু হেলিকপ্টারে করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। সেহেতু হেলিকপ্টারেই তাকে খতম করা যায়। তাকে মেরে সুবিধাজনক ভাবে কোনো একটা নদীতে লাস ফেলে দিলেই হয়ে গেল। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনাও বাদ দিতে হয় (কেন বাদ দেয় তার কারন জানা যায় নি)।

শেষ মেশ সিদ্ধান্ত নিলো ৩২ নং রোডের বাড়িতে গিয়েই তাকে খুন করবেন। সে জন্যে যথেষ্ট পড়াশোনা দরকার। প্রায় প্রতিদিন রাত ১০টায় কাছাকাছি ফারুক বের হতেন। গায়ে থাকত বুশ-শার্ট, পরনে লুঙ্গি আর পায়ে সেন্ডেল। লেকের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ ৩২ নং রোডে ডুকে যেতেন। মৃত্যুর দূত হয়ে মুজিবের গতিবিধি, অভ্যাস, কাজ, খাবারের জায়গা সব কিছু খুটিয়ে দেখতেন। তাদের মুল পরিকল্পনায় ছিল মাত্র ৩ জনকে হত্যা করা। শেখ মুজিব, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (শেখ হাসিনার ফুফা) এবং শেখ ফজলুল হক মনি (শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগিনা ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা) কে হত্যা করা। আর মুজিবের দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামালকে বন্দি করা। 

পরিকল্পনা মোতাবেক প্রাক্তন মেজর নূর এবং মেজর মহিউদ্দিন নিলেন বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে সড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব। ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন এনসিও রিসালদার মুসলেমউদ্দীন নিলেন শেখ মনির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব। আর মেজর ডালিমকে মুজিবের বাসায় আক্রমনের দায়িত্ব দিতে চাইলেও তিনি সেটাতে রাজী না হয়ে 
আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণ করতে প্রস্তুত হন। তবে পরিকল্পনায় বাধা আসলে প্রয়োজনবোধে নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ ছিল। আসলেই এই নির্দেশই হত্যাযজ্ঞের পরিধি প্রশস্ত করে। 

আর এই আক্রমণের মাস্টার মাইন্ড ফারুক নেয় রক্ষীবাহিনী সামলানোর দায়িত্ব আর রশিদের দায়িত্ব মোশতাক আহমেদকে নিয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে এসে মুজিবের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের নাম ঘোষণা করা। তারপরের হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা তো সবার জানা। তিনটি পরিবার থেকে ও বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয় সহ মোট ২৬ জনকে সে রাতে খুন হতে হয়।

আচ্ছা ৬০০ জন মানুষ এত ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনা করল আর সেটা কেউ বুঝতেই পারল না এমন টা কিন্তু না। যখন মেজর রশিদ ও ফারুক পরিকল্পনা আটছিল তখনই ভারতের RAW বিশ্লেষণমুলক তথ্য পাচ্ছিলো যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবন বিপন্নের আশংকা আছে। ফলে তখনকার RAW-এর প্রধান রামেশ্বরনাথ ছদ্মবেশে ঢাকা এসে মুজিবকে সতর্ক করেন এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বিষয়টা জানতেন। 

আবার, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার বিচারে ৭২ জনের সাক্ষ্যপ্রমাণ নেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৬২ জন কোটে এসে সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে ৪২ নং সাক্ষী ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি তার সাক্ষ্য প্রমাণে বলেন, "ডিজিএফআই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের বেশ আগে একটি লিখিত রিপোর্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে জমা দিয়েছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার ষড়যন্ত্র করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছে।" 

আচ্ছা এখানে বলে রাখি তখন জিয়াউর রহমান ডিজিএফআই তে কর্মরত ছিলেন। আর ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। এনএসআই ও বিশেষ শাখার সাথে এই সংস্থা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ডিজিএফআই ষড়যন্ত্রের আন্দাজ করে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে লিখিত রিপোর্ট জমা দেওয়ার অর্থ তখনকার সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও বিষয়টাতে অবগত ছিল। 

এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিলো। সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাসের লেখা "বাংলাদেশঃ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড"বইয়ের ৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, মেজর ফারুকের বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে রশিদের বাসায় ঢুকে রশিদকে জানায় দেশে নাকি খুব শীঘ্রই একটা সামরিক অভ্যুত্থান হতে যাচ্ছে।"

এমন গুজব যদি ভার্সিটিতে ছড়ায় তাহলে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুজিবের কানেও পৌচ্ছিলো। তাহলে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি কেন? তিনি পদক্ষেপ নেন নি এমনটা না। পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আশঙ্কা করেছিলেন সেনাপতির দিক থেকেই বিপদ আসতে পারে। তাই গোয়েন্দা বিভাগকে শুধু মাত্র সেদিকে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। জুনিয়র অফিসারেরা তার চিন্তার বাইরেই ছিল। আর তাদের হাতেই তাকে জীবন দিতে হলো।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ, ১৫ আগষ্ট হত্যা মামলার রায়, উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন সংবাদ পত্র)

লেখক: সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ, শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক  হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। 

আমারসংবাদ/এআই