রায়হান আহমেদ তপাদার
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১, ০৬:২০ এএম
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে গত শতাব্দী নানা নাটকীয়তা ও সমীকরণে শেষ হয়েছে। শতাব্দী জুড়ে ছিল বড় দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও অর্ধশত বছর ধরে চলেছে দুই পরাশক্তির মধ্যে কথিত ঠান্ডা যুদ্ধ। ঠান্ডা যুদ্ধের পতনের পর নব্য উদারবাদী তাত্ত্বিকরা আঞ্চলিক সংগঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব শান্তি ও সমতা তৈরির স্বপ্ন দেখেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা ও স্যামুয়েল হান্টিংটনের ক্লাস অব সিভিলাইজেশন তত্ত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিবিধি পাল্টে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারবাদী তত্ত্বকে আমলে নিয়ে জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়।
২৫ বছরের মধ্যে সংঘটিত হওয়া আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ জাতিপুঞ্জের পতন ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জয়ী পক্ষ নিজেদের আয়ত্তে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সূচনা করে জাতিসংঘ গঠন করে। রাজনীতির বাঁকে বাঁকে আসে উত্থান-পতন। আফগানিস্তান এখন তালেবানদের দখলে। তারা আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট আমেরিকান সৈন্যরা লজ্জাজনকভাবে রাতের অন্ধকারে আফগানিস্তান থেকে পলায়ন করেছে। এটা কেবল আফগানিস্তান থেকে পলায়ন নয়, বরং বিশেষজ্ঞদের মতে এ ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হতে পারে।
শুরু হয়েছে নতুন হিসাবনিকাশ। আমেরিকা বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে ছিটকে পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ আমেরিকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। অন্য দিকে রাশিয়া তালেবানদের ব্যাপারে এক রকম নীরব থাকলেও চীন এবং পাকিস্তান তালেবানের সঙ্গে যে ভাল সম্পর্ক রাখবে তা বোঝাই যাচ্ছে।
সবকিছু মিলিয়ে বিশ বছরের আফগান যুদ্ধে আমেরিকার লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নতুন শক্তির আগমন হতে পারে কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
তবে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের প্রশ্ন হলো যে, অবশেষে যদি তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করে ইঙ্গ-মার্কিনীদের আফগানিস্তান ছাড়তে হলো তাহলে দীর্ঘ বিশ বছর পর্যন্ত একটি দরিদ্র দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে রাখা হলো কেন? বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা ঘোষিত ‘মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী’ বা এক নম্বর সন্ত্রাসীর লাশ এত তড়িঘড়ি করে কেন সাগরে ফেলে দেয়া হলো? যে লোকটির জন্য এত যুদ্ধ, এত ধ্বংসযজ্ঞ, এত রক্তপাত তাকে নিয়ে কেন এত লুকোচুরি?
এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত আর কোনদিন জানা যাবে না। একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হলো যে, বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তার সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রুকে ধরতে দশ বছর সময় লেগেছিল এবং তারা তাকে জীবিত গ্রেফতার করতে পারেনি। টুইন টাওয়ার ট্র্যাজেডির আজ বিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই বিশ বছরে বিশ্ববাসী অনেক উত্থান-পতন দেখেছে। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই এবং আশরাফ ঘানি দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এরই মাঝে খোদ আমেরিকায়ও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে মোট চারবার।
২০০১ সালে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত আফগানিস্তানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনী অবস্থান করেছিল। ক্ষমতাচ্যুত তালেবানরা ন্যাটোবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিল। মার্কিন মদদপুষ্ট আফগান সরকার, আফগান সেনাবাহিনী এবং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনী মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে দীর্ঘ বিশটি বছর চেষ্টা করেছেন তালেবান এবং আল কায়েদাদের নির্মূল করার জন্য। প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্যকে জীবন দিতে হয়েছে এই সময়ে আফগান যুদ্ধে। তালেবানদের দমন করার পরিবর্তে ২০২০ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবান নেতাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ একটি দেশ হলো বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকা। সে দেশে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ২০০১ সালের ১১ সেপ্টম্বর এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হামলায় ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাও আবার আমেরিকার চারটি বিমান ছিনতাই করে। নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলায় চারটি বিমানের ২৬৮ যাত্রীসহ কয়েক হাজার মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির হার ছিল আনুমানিক ১০ হাজার ৫ শত কোটি ডলার। এই হামলায় আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. জর্জ ডব্লিউ বুশ এ হামলার জন্য আল কায়েদা নেটওয়ার্কের প্রধান উসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেছিলেন।
সে সময় লাদেন আফগানিস্তানে অবস্থান করছিলেন। আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তালেবান। প্রেসিডেন্ট বুশ তালেবান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন উসামা বিন-লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার জন্য। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা ও আফগানিস্তানের ইসলামী ইমারতের আমির উল মুমিনীন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর কোন প্রমাণ ছাড়া উসামা বিন-লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দিতে রাজি হননি।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০১ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ব্রিটেনসহ তার মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ শুরু করেন। টানা দুই মাসের বোমাবর্ষণে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় খরা-দুর্ভিক্ষপীড়িত আফগানিস্তানকে। হত্যা করা হয় হাজার হাজার নারী ও শিশু এবং নিরপরাধ মানুষকে। উৎখাত করা হয় তালেবান সরকার। হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকার গঠন করে সেখানে এক প্রকার দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রশ্ন উঠেছিল, বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিন্ন করে চারটি বিমান কিভাবে ছিনতাই করা হলো? লাদেনকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য অন্য কোনভাবে তালেবান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যেত। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে তছনছ করে দেয়া হলো কেন? একই কায়দায় ধ্বংস করা হয় সভ্যতার লীলাভূমি খ্যাত ইরাককে। সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে- এই অভিযোগে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ থেকে ইরাকে শুরু হয় ইঙ্গ-মার্কিনীদের বিমান হামলা। বোমার আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় দেশটিকে। অবশেষে সেখানে কোন বেআইনী অস্ত্র পাওয়া যায়নি।
বহু প্রাণহানি ঘটিয়ে সাদ্দাম সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ইরাক ও আফগানিস্তানের অসম যুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ১০ লাখের বেশি নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। আফগানিস্তানকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েও উসামাকে পাওয়া যায়নি। এক পর্যায়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের ৬২ কিলোমিটার উত্তরে এবোটাবাদে একটি বাড়িতে উসামা বিন-লাদেনকে পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ২ মে মার্কিন সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। লাদেনের লাশ সাংবাদিকদের দেখানো হয়নি। মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো কেবল জানিয়েছিল যে, উসামার লাশ সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে।
২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পর বৈরী সম্পর্কের দেশসমূহও বাণিজ্য সম্পর্কে জোর দেয়। এই সময়ে জাপানের অর্থনীতির পতন ও চীনের অর্থনীতির উত্থান নতুন এশিয়াকে সামনে আনে। একই সময়ে কথিত আরব বসন্তের উত্থান, চীনের মার্কিন আধিপত্য মোকাবেলায় ব্রিকস গঠন ও দরিদ্র দেশে বিনিয়োগ কূটনীতি ভূ-রাজনৈতিক নতুন সমীকরণ নিয়ে আসে। সব সমীকরণ বদলে দিয়েছে কোভিড-১৯ মহামারী। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য নতুন শীতল যুদ্ধ সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীনকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান গঠন করেছে সামরিক জোট। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে মেডিক্যাল সহায়তার মাধ্যমে অনেক দেশকে নিজের বলয়ে নিয়েছে চীন।
চীনের নেতৃত্বে রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের জোট আলোচনায় আছে। বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে ভারত, ইসরাইল, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত রয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে চারবার যুদ্ধে জড়ানো আরবরাই আজ ইসরাইলের নিকট বন্ধু। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর আগের মতো কর্তৃত্ব নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। জার্মানি ও ফ্রান্স নিজেরাই পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্নে বিভোর। ফলে বহুমেরু বিশ্বের উত্থান হতে যাচ্ছে।
এখনও বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে কোন সময় বদলে দেয়ার সক্ষমতা রাখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালে ৭৩ হাজার কোটি ডলার সামরিক বাজেট করা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বজুড়ে রয়েছে ৮০০ সামরিক ঘাঁটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনও সামরিক নির্ভর। জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের শত্রু দরকার। সন্ত্রাসবাদের যুদ্ধের কথা বলে আফগানিস্তান, ইরাক ধ্বংস করেছে। এখন সোভিয়েত রাশিয়ার জায়গা করে নিচ্ছে চীন।
দুই দেশই তাদের সম্ভাব্য শীতল যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দিয়ে অনেক দেশকে নিজেদের আয়ত্তে নিতে চাচ্ছে। চলছে নতুন উপনিবেশবাদ তৈরির মহাপ্রস্তুতি। উপনিবেশবাদের চেহারাও বদলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে সে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থা চলতে পারে আফ্রিকা ও এশিয়ার তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে।
আমারসংবাদ/এআই