২০২৪ সালের ১৭ জুলাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি রক্তাক্ত দিন হিসেবে স্মরণীয়। সেদিন কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ, ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক কর্মীরা। বরিশালেও ঘটে ভয়াবহ সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা।
সেই দিনের পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন বরিশাল মহানগর বিএনপির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সুরুজ সিকদার ওরফে ‘কালু’।
এখনও তার শরীরে পুলিশের ছোড়া স্টিল বুলেটের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। সর্বশেষ বরিশালের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার পা ও হাত থেকে ছয়টি বুলেট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। তবে গলার ভিতরে এবং মাথায় থাকা গুলি অত্যন্ত জটিল ও জীবনঝুঁকিপূর্ণ।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উন্নত চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ হওয়া প্রায় অসম্ভব।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে কালুর চিকিৎসা ব্যয় বহনে তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কালু বলেন, “আমি উপার্জন করতাম, পরিবার চালাতাম। এখন বিছানায় শুয়ে থাকি, ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো খাবার দিতে পারি না।” অর্থাভাবে চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না।
সর্বাধিক আশ্চর্যজনক হলো, ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকায় কালুর নাম নেই। রাজপথে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ও গুরুতর আহত হওয়ার পরও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি তিনি। কালুর স্ত্রী জানান, আহত হওয়ার পর পুলিশ হাসপাতালে এসে তাকে গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিল।
২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও রাজনৈতিক কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, “আন্দোলনের সময় আমরা যারা রাজপথে ছিলাম, তাদের নাম কোথায়? প্রকৃত যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে তালিকায় এসেছে অনেক অনুপস্থিত নাম।” তারা দাবি করেছেন, কালুর নাম অবিলম্বে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলেন, “জুলাই আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন, অনেকের নাম তালিকায় নেই। তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি ও কারচুপি হয়েছে।” তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন, কিন্তু তার নামও তালিকায় নেই।
বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, “প্রথম ধাপে ৩৮৯ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬০ জনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কালুর আবেদন নির্ধারিত সময়ের পরে আসায় এমআইএস-এ আপলোড করা যায়নি।” তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।”
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. খালিদ মাহমুদ বলেন, “কালুর শরীরে এখনও বিপজ্জনক স্থানে গুলি রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা ছাড়া সেরে ওঠা কঠিন, তবে এতে বিপুল ব্যয় প্রয়োজন।”
কালুর স্ত্রী বলেন, “আমি বারবার তাকে আন্দোলনে না যেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে শুনেনি। এখন তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অনেকেই সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আর কেউ খোঁজ নেয়নি।” তিনি রাষ্ট্র ও দলীয় নেতাদের কাছে আবেদন করেছেন, “আমার স্বামীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন এবং তাকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিন।”
এক বছর কেটে গেছে। গুলিবিদ্ধ কালু আজও ঘরে বসে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছেন। সচেতন মহল বলছে, “প্রকৃত ত্যাগী যোদ্ধাদের অবহেলা করা উচিত নয়। কালুর মতো কর্মীদের তালিকাভুক্ত করে রাষ্ট্রকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
ইএইচ