ববিতে শুধু নামেই নিষিদ্ধ রাজনীতি, বাস্তবে উন্মুক্ত মাঠ 

ববি প্রতিনিধি  প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৫, ১১:৫২ এএম

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) কাগজে-কলমে রাজনীতি নিষিদ্ধের একবছর হলেও বাস্তবে রাজনীতি বন্ধ হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। অবাধে ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গতবছরের ১১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫ তম সিন্ডিকেট সভায় ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন ও সকল পেশাজীবী সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবচিত্র উলটো নিষিদ্ধ ঘোষণার বছর না পেরোতেই ক্যাম্পাসে ফের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে দেদারসে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। 

পেশাজীবী সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী কর্মচারী পরিষদ নামে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে কিছুদিন আগে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন ড্রাইভার মামুন শেখ ও সদস্যসচিব সিকিউরিটি গার্ড জাকির মৃধা। 

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো প্রত্যেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সক্রিয়ভাবে। গত ২৯ জুলাই ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়ায় কীর্তনখোলা অডিটোরিয়ামে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে কর্মী সম্মেলন করেছে। কর্মী সম্মেলন করতে গিয়ে অডিটোরিয়ামের কয়েকটি চেয়ারও ভেঙেছে বলে জানা গেছে।  

রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কর্মী সম্মেলনের জন্য জীবনানন্দ দাশ কনফারেন্স হলের জন্য আবেদন করে ছাত্রদল নেতা মোশারফ হোসেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাড়া না দিলে তারা জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্তনখোলা অডিটোরিয়াম ব্যবহার করে কর্মী সম্মেলন করে। রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসটিতে নতুন করে কমিটি দিতেই তোড়জোড় করে কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করে ছাত্র সংগঠনটি।

এছাড়াও ছাত্র সংগঠনটি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে নবীন শিক্ষার্থীদের কলম, ফুল এবং বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা দাবি সংশ্লিষ্ট লিফলেট বিতরণ, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা, বিজয় দিবসের র‍্যালি ও মিছিল, বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে দলটির নেতা-কর্মীরা। 

ইসলামি ছাত্রশিবিরকেও সক্রিয়ভাবে নিজেদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কার্যক্রম করতে দেখা গেছে। গত ৩৬শে জুলাই উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে মিল রেখে সাইকেল র‍্যালি বের করা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, মিলাদ মাহফিল, ইদুল আজহায় শিক্ষার্থীদের ভোজ, ভর্তি সহায়তা ডেস্ক বসানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করে ছাত্র সংগঠনটি। 

গত ২২শে জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল তাদের নিজেদের ব্যানারে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করে। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশও তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একাধিক প্রোগ্রাম করতে দেখা গেছে। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কোনো কমিটি না থাকলেও পদপ্রত্যাশীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নাম্বার গেটের সম্মুখে এনসিপির বড় একটা ব্যানার সাটিয়েছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পদপ্রত্যাশী রাশেদুল ইসলাম।

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে কমপক্ষে ২০জন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতেই সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বছর না ঘুরতেই ছাত্র সংগঠনগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিষয়টি দুঃখজনক। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তারা আরও দায়িত্বশীল ভূমিকায় দেখতে চান। 

শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে আইনীভাবে অনুমোদন নিয়ে যেন ছাত্র সংগঠনগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এই নীরব ভূমিকা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কাছে তাদের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন। 

শিক্ষার্থীরা জানান, বিগত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের কাছে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়েছিলো এখনো তেমনি ছাত্রসংগঠনগুলোর কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসন। না হলে, প্রশাসনের নাকের ডগায় ছাত্রসংগঠনগুলোর এমন  রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতো না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আসিফ বিল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু রাজনীতি নিষিদ্ধ সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলো কীভাবে রাজনীতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে? নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এমন কার্যক্রমে প্রশাসনের নীরব ভূমিকার সমালোচনা করে প্রশাসনকে তার অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানান তিনি। 

বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি মেহেদি হাসান সোহাগ বলেন, বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও এখনো ক্যাম্পাসে অবাধে চলছে রাজনীতির চর্চা। আমরা দেখতে পাচ্ছি ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল সহ সকল রাজনৈতিক দল গুলোর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন অবাধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, নেই কোনো নজরদারি। যা আসলে ১১ আগস্ট ২০২৪ এর ঘোষণার পরিপন্থি।  দ্রুতই এ বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক সুজয় বিশ্বাস শুভ  বলেন, ক্যাম্পাসে যারা রাজনীতি করতে চায় এবং যে রাজনীতি করতে চায় না উভয়েরই সুযোগ  দেয়া উচিত প্রশাসনের। কেউ যেন কারো উপরে কোন নিপীড়ন করতে না পারে সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে অগণতান্ত্রিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন তিনি। 

ইসলামি ছাত্রশিবিরের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির মনে করে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে তাদের চিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতি চর্চা থাকা উচিত। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ সময়ব্যাপি শিক্ষকদের অপরাজনীতি শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা, যদি কোন রাজনীতি বন্ধ থাকে সেটা অবশ্যই সর্বপ্রথম শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতি বন্ধ হওয়া উচিত। আগামী দেশ বিনির্মাণে সুস্থ ধারার মেধা বিকাশের ভিত্তি হিসেবে ছাত্র রাজনীতি থাকা দরকার। সৃজনশীল ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমেই গবেষণা বান্ধব একটি ক্যাম্পাস গড়ে ওঠা উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রেজা শরীফ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। সকল ছাত্র সংগঠনগুলো যেমন রাজনীতি নিষিদ্ধের পরও কার্যক্রম পরিচালনা করছে ছাত্রদলও তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান রেখেই ক্যাম্পাসে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা করছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. রাহাত হোসাইন ফয়সাল বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গতবছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিন্ডিকেটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সুতরাং ক্যাম্পাস এরিয়ায় ছাত্র রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। যারা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে তাদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার  অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বন্ধ থাকায় এমন কার্যক্রমে কেউ যুক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিধিমোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না এবিষয়ে প্রক্টর ও উপাচার্যের সাথে কথা বলার জন্য বলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, রাজনীতি যেহেতু নিষিদ্ধ সেহেতু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজনৈতিক কার্যক্রম চললেও তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেএইচআর