জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অতীতের দ্বন্দ-সংঘাত গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রায় সকল সংঘাত-সংঘর্ষের নেতৃত্ব দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী তথা অছাত্ররা।
সম্প্রতি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর ন্যাক্কারজনক হামলায় জড়িতের অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ১১০ শিক্ষার্থীকে শোকজ করা হয়। এর মধ্যে ৭৭ জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বাকি ৩৩ জন বর্তমান শিক্ষার্থী। তারা সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিল।
এছাড়া বিগত সময়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাবি ক্যাম্পাস ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর অপরাধ সিন্ডিকেট। এরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, জমি দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। আর এ পুরো অপরাধচক্র আবর্তিত হতো সাবেক শিক্ষার্থী বা অছাত্রদের দ্বারা। অপরাধচক্রের হোতা এই সাবেক শিক্ষার্থীদের আশ্রয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীরাও এতে যুক্ত ছিল।
২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা অভিযুক্ত ছিল তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান। সহযোগী হিসেবে ছিল সাব্বির হাসান সাগর, সাগর সিদ্দিক ও হাসানুজ্জামান যারা প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ সাবেক শিক্ষার্থী।
এটাই একমাত্র ধর্ষণের ঘটনা নয়, জাবিতে ধর্ষনকাণ্ড প্রথমবারের মতো আলোচনার শীর্ষে আসে ১৯৯৮ সালে। তৎকালীন সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সন্ত্রাসী জসিম উদ্দিন মানিক শততম ধর্ষণ করে মিষ্টি বিতরণ করেছিল। সেই সময় বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নানা টালবাহানার পর জাবি প্রশাসন তাকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। এরপর ক্যাম্পাসটিতে আরও অনেকবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যার প্রায় প্রত্যেকটিই সংঘটিত হয়েছিল রাজনৈতিক পদধারী অছাত্রদের দ্বারা।
ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, জাহাঙ্গীরনগরের বিভিন্ন দোকানপাট থেকে মাসোহারা আদায়, বিশমাইল এলাকার পরিবহণ টিকিট কাউন্টার থেকে চাঁদা আদায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত বিভিন্ন পরিবহণ থেকে যে চাঁদা আদায় করা হতো তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো ছাত্রলীগের পদধারী অছাত্রদের মাধ্যমে।
এছাড়া ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, শিক্ষার্থীদের মারধর, বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মারধর, শিক্ষকদের অপদস্থ করা, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে হুমকির মুখে রেখেছিল এই সাবেক রাজনৈতিক শিক্ষার্থীরা।
২০২৩ সালের ২৩ মার্চ মীর মশাররফ হোসেন হল ও রবীন্দ্রনাথ হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হল থেকে রড, রামদা, লাঠি ও ছুরিসহ বিভিন্ন দেশীয় নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের দিকে আক্রমণ চালায়। এসময় সাংবাদিকদেরকেও আক্রমণ করে আহত করা হয়। এ সন্ত্রাসী হামলার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেনিন মাহবুব, সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ, আবুল কালাম আজাদ এবং আবদুল্লাহ আল ফারুক ইমরানসহ অনেকে। যারা প্রত্যেকেই ছিল ক্যাম্পাসের মেয়াদোত্তীর্ণ সাবেক শিক্ষার্থী।
একই বছর মার্চ মাসে সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে অছাত্রদের নেতৃত্বে দফায় দফায় অস্ত্রের মহড়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় চলন্ত বাসে লক্ষ্মীপুরের এক যুবককে অচেতন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সালাম-বরকত হলে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে তাকে নির্যাতন এবং ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে জাবি শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসীত পালের বিরুদ্ধে। একই বছরের ৬ এপ্রিল এসবি সুপার নামের একটি বাস আটকে দুই লাখ টাকা দাবি করে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক শেখ রাজু। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন মেয়াদোত্তীর্ণ সাবেক শিক্ষার্থী।
২০২৩ এর এপ্রিলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম তালুকদারের সিএন্ডবি এলাকার নার্সারি থেকে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সাবেক শিক্ষার্থী জাবি ছাত্রলীগের উপ-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনসহ আরও কয়েকজন নেতা।
টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা নার্সারিতে তালা ঝুলিয়ে দেয়। একই বছরের অক্টোবরে শহিদ রফিক-জব্বার হলে এক ক্যাবল অপারেটর ইন্টারনেট বিল আনতে গেলে তাকে আটকে চাঁদা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদি হাসান জয়।
২০১৯ সালের ৩ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। এতে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬৫ জনের মতো শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন যার ঘটিত হয়েছিল ছাত্রলীগের পদধারী অছাত্রদের নেতৃত্বে।
২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি সংঘটিত তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও মাওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগের কর্মীদের সংঘর্ষে দেখা যায় শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা রড, রামদাসহ দেশিও অস্ত্রসহ হামলা করে মাওলানা ভাসানী হলের শিক্ষার্থীদের ওপর। এসময় উপস্থিত সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করে আহত করা হয়। হামলাকারীরা প্রত্যেকেই ছিল তৎকালীন অছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা কুখ্যাত সন্ত্রাসী শামীম মোল্যার অনুসারী।
২০১৪ সালের ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৪ জন আহত হয়েছিলেন। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাশে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত ‘ঢাকা বিরিয়ানি হাউজ’ এ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক বশিরুল হকের নেতৃত্বে জোরপূর্বক ফ্রি খাওয়া নিয়ে তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনি ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদের গ্রুপ এর মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন তৎকালীন সাবেক শিক্ষার্থী।
জেএইচআর