প্রিন্ট সংস্করণ॥নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ৩, ২০১৯, ০৬:৩০ পিএম
আজ রোববার শোকাবহ আগস্টের চতুর্থদিন। শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধা জানাবে বাঙালিরা। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ডাক দিলেন ৭ মার্চ। বললেন- মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব।
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রা্ম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল স্বাধীনতার তরঙ্গ। জেগে উঠল বাংলাদেশ।
কিন্তু এই সময় স্বাধীনতাকামী বাঙালির পাশে তাদের সেই মহান নেতা নেই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। মহান নেতাকে পাশে না পেয়ে বাঙালি সাহস হারায়নি। এক মুজিব সাড়ে সাতকোটি মুজিবে পরিণত হল।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনলো বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। স্বাধীনতার পরে আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল পাক সরকার। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলায়। বাঙালিকে কাছে পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন।
পাকিস্তানের কারগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সেই নিকৃষ্ট পরিকল্পনার কথা জানালেন। বললেন, ধামার সেলের সামনে আমার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছিল। আমি বলেছিলাম, তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলে যাব, আমি বাঙালি, বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা”। তবে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। সে আন্তর্জাতিক চাপে হোক আর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছ হার মেনে হোক।
পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল। পাকিস্তানিরা ব্যার্থ হলেও স্বাধীন বাংলায় অবস্থানকারী কিছু পাকিস্তানি মনোভাবের বাঙালি নামের কলঙ্কিত বিপথগামী সৈনিকরা সে কাজ করেছিল।
জাতির জনক স্বাধীন বাংলা গড়তে ব্যস্ত। অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাকে সোনার বাংলা গড়তে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যরা। তখনও ভোর হয়নি।
আকাশে হালকা হালকা আলো। বাড়িতে গার্ড পরিবর্তনের সময়। ডিউটিতে আছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মহিতুল ইসলাম। রাত একটার দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ করে একটা ফোন এল। ঘুমের মধ্যে ফোন ধরলেন। ফোনের অপর পাশে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মহিতুল ইসলামকে বললেন, পুলিশ কন্ট্রোল রুম এর সাথে যোগাযোগ কর। এইমাত্র তিনি খবর পেয়েছেন তার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছে। মহিতুল পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ডায়াল করেন কিন্তু কিছুতেই সংযোগ পান না।
তারপর তিনি গণভবন এক্সচেঞ্জ এর সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। অপরপাশে কেউ একজন ফোন ধরে, কিন্তু কোন কথা বলে না। বঙ্গবন্ধু অস্থির হয়ে মহিতুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেন যে- কেন তিনি পুলিশ এর সাথে যোগাযোগ করেননি! মহিতুল ইসলাম এই দুঃসংবাদটি জানান যে, তিনি কোথাও যোগাযোগ করতে পারছেন না। বিরক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু রিসিভারটি মহিতুল ইসলাম এর কাছ থেকে নিয়ে নেন।
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বলছি, তিনি উচ্চারণ করেন। আর সাথে সাথে মহিতুল ইসলাম এর অফিস এর কাচ ভেঙে যায় গুলিতে। বঙ্গবন্ধু তখন ও বুঝতে পারেননি যে তাকে হত্যা করার মিশন শুরু হয়ে গেছে। একথাও জানতে পারেননি যে, এই সকাল তার জীবনের শেষ সকাল। প্রকৃতির সূর্য উঠলেও বাংলার স্বাধীনতার সূর্য উঁকি দিয়ে আবার অস্ত যাচ্ছে। সেই ভোর আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল।
হাবিলদার মোহাম্মাদ কুদ্দুস সিকদার তখন সাতজন গার্ডকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসস্থানের পতাকা স্ট্যান্ডে জাতীয় পতাকা লাগাচ্ছিলেন। তখনই তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। গার্ডরা দ্রুত বাউন্ডারি ওয়াল এর পিছনে অবস্থা নিয়ে নেন।
তাদের সামনে দিয়েই কাল এবং খাকি ইউনিফর্ম এর আর্মির লোকেরা ঢুকে পড়ে বাড়িতে। “হ্যান্ডস আপ” -গার্ডদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে তারা। সেই সাথে হয় দুঃস্বপ্নের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর কাজের ছেলে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি আর চশমা এনে বঙ্গবন্ধুর হাতে দেয়।
সেগুলো পরে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রিদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ওঠেন -”চারপাশে ফায়ারিং হচ্ছে। তোমরা কি করছ ?” সাথে সাথে তিনি উঠে ওপরে যান। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে। জাতির পিতা তখনও জানতেন না এটাই তার পরিবারের সাথে তার শেষ দেখা।
আরেকজন হাউসহেল্পার রমা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের বাইরে বারান্দায় ঘুমিয়েছিল। তখন ভোর পাঁচটা। হঠাৎ করে বেগম মুজিব ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণের শিকার।
রমা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। অস্থিরভাবে দৌড়ে সামনের গেট এর কাছে গিয়ে দেখে অস্ত্র নিয়ে আর্মির লোকেরা ৬৭৭ নম্বর বাড়ির দিকে আগাচ্ছে। রমা পুনরায় দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। শেখ কামাল সুলতানার ঘরে গেল।
শেখ কামালকে উঠিয়ে কোনোরকমে আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয়। কামাল দ্রুত নিচতলায় নেমে আসেন। সুলতানাকে রমা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে নিয়ে যায়। শেখ জামাল এবং তার স্ত্রী কেও উঠিয়ে খবরটা জানায় রমা। সবাই বেগম মুজিবের ঘরে চলে আসেন। চারদিকে বুলেটের আওয়াজ। নিচতলায় কারও আর্তনাদ শুনতে পান শেখ জামাল। তখনও জানতেন না এ আর্তনাদ ছিল তার বড় ভাই শেখ কামালের।
ততক্ষণে আর বেঁচে নেই বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল। শেখ কামালকে নিচে নেমে আসতে দেখেন মহিতুল। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠেন, আর্মি এবং পুলিশের সদস্যরা, আমার সাথে আসুন। তিনি চাইছিলেন হামলাকারীদের অবস্থান বুঝতে।
এর কিছুক্ষণ পরেই খুনীরা সামনে চলে আসে কালো এবং খাকি ইউনিফর্ম এ তিন চার জন। ওয়েস্ট লেভেল এ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তারা শেখ কামালের ঠিক সামনে গিয়ে থামে। পিছনে স্তব্ধ হয়ে যান মহিতুল এবং নুরুল ইসলাম। মহিতুল চিনতে পারেন মেজর বজলুল হুদাকে।
আর্মিরা প্রথমে শেখ কামাল এর পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল মহিতুল ইসলাম এর পাশে সরে আসেন। মহিতুল চিৎকার করে ওঠেন- ওকে গুলি করো না, ও শেখ কামাল, বঙ্গবন্ধুর ছেলে।
এমন সময় আর্মির সদস্যদের কতগুলো বুলেট এসে শেখ কামালের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। পুলিশকে মহিতুল এবং নুরুল ইসলাম এর দিকে নজর রাখতে বলে ভারী পদক্ষেপে খুনীরা ফার্স্ট ফ্লোর এর দিকে এগিয়ে যায়। কিছুসময় পর বঙ্গবন্ধুর সুউচ্চ ভরাট কণ্ঠস্বর শুনতে পান মহিতুল ইসলাম।
এরপর গুলির শব্দ। কি হচ্ছে কিছুই কল্পনা করতে পারছিলেন না মহিতুল ইসলাম। শুধু প্রার্থনা করছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধুর কিছু না হয়। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনাটি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেন হাবিলদার কুদ্দুস। আর্মিদের কথামত একতলায় তাদেরকে অনুসরণ করেন কুদ্দুস।
হুদা এবং নূর সিঁড়িতে পা দেয়ার সাথে সাথে বিপরীত দিক থেকে মেজর মহিউদ্দিন আর তার সৈন্যরা চলে আসে। তাদের সাথে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাবিলদার কুদ্দুস ছিলেন হুদা এবং নূর এর ঠিক পিছনে।
নূর ইংরেজিতে কিছু বললে মহিউদ্দিন আর তার সৈন্যরা সরে যায়। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেন, তোমরা কি চাও? কেউ উত্তর দেয়না। হুদা আর নূর এর অস্ত্র থেকে একঝাঁক বুলেট ছুটে যায় বঙ্গবন্ধুর দিকে। নীরবে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। চারপাশে এবং সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়তে থাকে মহানায়কের রক্ত।
জাতির পিতার রক্ত। তখনও তার প্রিয় পাইপটি তার হাতে ধরা। মহিউদ্দিন, নূর, হুদা এবং অন্যরা বাড়ির দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়। বুলেটের ধাক্কায় বঙ্গবন্ধুকে লুটিয়ে পরতে দেখে রমা।
কাঁপতে কাঁপতে বেগম মুজিবের রুমের বাথরুমে ঢুকে যায় । সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজি, শেখ রাসেল, শেখ নাসের সবাই সেখানে ছিলেন। শেখ নসের এর হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। রমা বেগম মুজিবকে জানায়, বঙ্গবন্ধু আর নেই।
এর কিছুক্ষণ পরেই খুনীরা ফিরে আসে এবং দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব বললেন, মরতে যদি হয় সবাই একসাথে মরব। বলে তিনি দরজা খুলে দিলেন।
আর্মির লোকেরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং রমাকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কেঁদে ওঠেন বেগম মুজিব। বলেন, আমি আর সামনে যাব না, আমাকে এখানেই মারো। খুনীরা বেগম মুজিবকে তার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
চোখের সামনে আরেকটি বীভৎস দৃশ্য দেখেন হবিলদার কুদ্দুস। মেজর আজিজ পাশা এবং রিসালদার মুসলেহউদ্দিন স্টেনগান থেকে ফায়ারিং শুরু করে। এক মুহূতের্র মধ্যে স্মৃতির পাতায় ইতিহাস হয়ে যান বেগম মুজিব, শেখ জামাল, সুলতানা, রোজি। শেখ রাসেল, শেখ নাসের এবং রমাকে নিচে নিয়ে গিয়ে মহিতুল এর সাথে এক লাইনে দাঁড়া করায় খুনীরা। শেখ নাসের বলেন, আমি রাজনীতির সাথে জড়িত নই। জীবিকার জন্য ব্যবসা করি।
একজন আর্মি কর্মকর্তা শেখ নাসেরকে বলে, আমরা তোমাকে কিছু করব না। এই বলে শেখ নাসেরকে মহিতুলের অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে গুলি চালায়। মৃতুর আগমুহূর্তে শেখ নাসের আর্তনাদ করছিলেন ‘পানি, পানি’ বলে। আর একজন আর্মি কর্মকর্তা গিয়ে পুনরায় গুলি চালায় শেখ নাসের এর ওপর। শেষ হয়ে যায় আরেকটি জীবন। খুনীরা এরপর ওপরে ওঠে এবং শেখ রাসেলকে নিয়ে নিচে নামে।
বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের শিশুপুত্র একবার রমার কাছে, একবার মহিতুল এর কাছে আশ্রয় খুঁজতে থাকে। শিশুটি প্রশ্ন করে, ভাইয়া, ওরা কি আমাকেও মারবে ? মহিতুল উত্তর দেন, “না, তোমাকে মারবে না।” এরপর কি হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না মহিতুল ইসলামের।
আর্মির একজন এসে মহিতুল এর কাছ থেকে রাসেলকে সরিয়ে নেয়। রাসেল তার মা এর কাছে যেতে চায়। ক্রন্দনরত রাসেলকে এক হাবিলদার নিয়ে যায় বেগম মুজিবের লাশের কাছে। তারপর আরো কিছু গুলি। নিথর হয়ে যায় শেখ রাসেল এর নিষ্পাপ ছোট্ট দেহটিও। কিছুক্ষণ পর খুনী ফারুক দেখা করে খুনী বজলুল হুদার সাথে। “তারা সবাই শেষ।” খুনী ফারুককে জানায় খুনী হুদা।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি হয়েছে। একবার কেন, ঐ খুনীদের লক্ষবার ফাঁসি হলেও বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা পূরণ হবার নয়। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পেরেছে তারা বাংলার মাটিতে বসবাসকারী হলেও বাঙালি নয়। বাঙালি হতে পারে না।
নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায়না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে। ঠিক যে নির্মম কাজ পাকিস্তানিরা করতে পারেনি। তা যারা করেছে তারা কোনো দিন বাঙালি হতে পারে না। আর এই বাঙালিদের বিশ্বাসও করা যায় না।
যারা পিতাকে হত্যা করতে পারে তারা পৃথিবীর এমন কোনো নিকৃষ্ট কাজ নাই যা না করতে পারে। যারা মুজিবকে হত্যা করেছিল তারা ভেবেছিল মুজিবকে বাংলা থেকে, বাঙালির হূদয় থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তাদের সে ধারনা ছিল ভুল। মুজিবের অস্তিত্ত সব বাঙালির হূদয়ে। বাঙলার প্রতিটি মৃত্তিকা কণার সঙ্গে মিশে আছে। যা কেউ কোনো দিন আলাদা করতে পারবে না।