Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

টানা সাতদিন ঘুমান ভম্বল শীল, খান ১০ জনের খাবার

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি

নভেম্বর ২৬, ২০২০, ১১:৩০ এএম


টানা সাতদিন ঘুমান ভম্বল শীল, খান ১০ জনের খাবার

অদ্ভুত হলেও সত্য ৩৫ বছর বয়সী ভম্বল শীল এক ঘুমেই কাটিয়ে দেন টানা সাতদিন। একাই দশজনের খাবার খেতে পারেন। এমন কি টয়লেটে গেলেও টানা দু-তিনদিন ঘুমিয়ে থাকেন তিনি। তবে তার কথাবার্তা শুনে স্বাভাবিক মানুষের মতোই মনে হলেও তার অস্বাভাবিক জীবন-যাপন দুই যুগ ধরে।

ভম্বলের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ভম্বল শীল। এক ভাই আর দুই বোন ভারতে থাকেন। বড় ভাই শংকর শীলের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন ভম্বল।

শংকর শীল পেশায় নরসুন্দর। অভাবের সংসার। বাড়িঘরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। ভাঙাচোরা একটি ঘরে একাই থাকেন ভম্বল। ঘুমানোর চৌকিটাও ভাঙা।

চিকিৎসকরা জানান, এটি একটি জটিল মানসিক রোগ। ভালো চিকিৎসা পেলে এ রোগ থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। তবে চিকিৎসা করানোর মতো সেই টাকা নেই ভম্বল শীলের পরিবারের।

স্বজনরা জানান, বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটান ভম্বল শীল। এক ঘুমে কাটিয়ে দেন পুরো সপ্তাহ। মাঝে মধ্যে উঠে টয়লেটে যান। তবে সেখানে গিয়েও ঘুমিয়ে পড়েন। টানা দু-তিনদিন টয়লেটেই কাটে। গোসলের জন্য একবার পুকুরে নামলে সকাল পেরিয়ে বিকেল হয়।

পারিবারিক সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, ছোটবেলা থেকে স্বাভাবিকই ছিলেন ভম্বল। ১৪-১৫ বছর বয়সে এক মেলা থেকে ফেরার পথে ভম্বল ভয় পেয়েছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে তার আচরণে পরিবর্তন আসতে থাকে। জিন-ভূতে ধরেছে মনে করে বহু কবিরাজ আর ফকিরের কাছে ঘুরেছেন স্বজনরা। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হলেও টাকার অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেননি।

ভম্বলের ভাই শংকর শীল জানান, মাসের পর মাস ভম্বল বাড়ি থেকে বের হন না। একটানা সাতদিন ঘুমিয়ে থাকেন। এর মধ্যে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। মাঝে মধ্যে টয়লেটেও ঘুমিয়ে যান। ঘুম থেকে জেগে উঠলে ক্ষুধার্ত হন তিনি। খেতে বসলে কয়েকজনের খাবার একাই খেয়ে ফেলেন। গোসল করতে গেলে সারাদিন লাগে।

শংকর শীল বলেন, আমার ছোট ভাই ভম্বলের বয়স ৩৮ বছর। ওর এমন সমস্যা প্রায় ২০ বছর ধরে। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল ভম্বল। তারপর থেকেই তার এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। আগে এত গুরুতর ছিল না এই সমস্যা। দিন যত যাচ্ছে সমস্যা আরও বাড়ছে।

তিনি বলেন, জিন-ভূতে আছর করেছে মনে করে তাকে বিভিন্ন কবিরাজ ও ফকিরের বাড়ি নেয়া হয়। একবার পাবনা মানসিক হাসপাতালেও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে চিকিৎসা করানো যায়নি। বিয়ে করালে ভালো হতে পারে এমন চিন্তায় ভম্বল শীলকে ধামরাইয়ে বিয়ে করানো হয়েছিল। কিন্তু একবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খেতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার এই অস্বাভাবিক জীবন-যাপন দেখে বাপের বাড়ি থেকে বউ আর আসেনি।

শংকর শীল বলেন, আমি অভাবী মানুষ, ফুটপাতে সেলুনের কাজ করি। দিনে দেড় দুইশো টাকা আয় হয়। আমার যে আয় তা দিয়ে নিজের পরিবারই চলে না। ভাইকে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য আমার নেই। সমাজের কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি আমার ভাইকে চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব নিতো তাহলে ভম্বল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো।

ভম্বলের ভাইয়ের স্ত্রী কল্পনা শীল বলেন, উনি (ভম্বল) নিজের ইচ্ছা মতোই চলে। কেউ ডাকাডাকি করলেও শোনে না। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। ১৫-২০ দিন পরপর গোসল করে। সকালে গোসল করতে গেলে বিকেলে আসে। আর উনি একাই কয়েকজনের খাবার খেতে পারে। সবসময় পেট ভরে খাবার খেতে দিতে পারি না আমরা। আমাদের সামর্থ্য মতো যতটুকু দিতে পারি তাতে ওনার হয় না। কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে গেলেই কেবল পেট ভরে খেতে পারে।

প্রতিবেশী বিপুল গোস্বামী বলেন, ভম্বল না খেয়েই পাঁচ-সাতদিন পার করে দেয়। বাড়ির লোক ডাকাডাকি করলেও বলে একটু পরে উঠবো। এই বলে আবার ঘুমায়। আর ও একাই এক-দেড় কেজি চালের ভাত খেতে পারে।

ভাড়ারিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অরুণ কুমার শীল ও স্থানীয় বাসিন্দা রাজিবসহ অনেকেই জানান, ভম্বলের এই অস্বাভাবিক জীবন-যাপন দেখে তারা আসলে খুবই অবাক হন। ভম্বলের ঠিকমতো খাবার জোটে না। কারণ তার ভাই পেশায় একজন নরসুন্দর। তার সামর্থ্য নেই। এ কারণে দিনের পর দিন না খেয়েই কাটান তিনি। এলাকায় কোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান থাকলে ভম্বল সেখানে গিয়ে পেট ভরে খান। বাকি সময় খাবারের চাহিদা মেটে না তার।

স্থানীয়রা জানান, আচরণে কোনো আগ্রাসী ভাব না থাকলেও ভম্বলের মধ্যে সবসময় ভয় আর অবিশ্বাসের ছাপ দেখা যায়। উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত।

ভম্বল শীল বলেন, একটানা পাঁচ-সাতদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি কোনোকিছু না খেয়েই। হাজার হাজার দিন চলে গেছে দুই-চারদিন ঘুমিয়েই। এক ফোঁটা পানিও খাইনি তখন।

তিনি বলেন, ছয় বছর আগে আমাকে বিয়ে করানো হয়েছিল। স্ত্রী এখন আর আমার সাথে থাকে না। বালিরটেক বাজারে দীর্ঘ কয়েক বছর রাতে পাহাড়াদারের কাজ করেছি। তার বিনিময়ে বাজার কমিটির লোকেরা আমাকে কোনো পারিশ্রমিকই দেয়নি। মাঝে মাঝে ৫০-৬০ টাকা দিয়েছে। এভাবেই আমাকে ঠকিয়েছে তারা।

ভম্বল বলেন, আমার শরীর অত্যন্ত দুর্বল, অস্থির অস্থির লাগে তাই খালি ঘুম আসে। আগেতো পাহারাদারের কাজ করতাম কিন্তু এখনতো কোনো কাজ বা আয় রোজগার নাই, তাই ঘুমাই। আর ঘুমাইলে ক্ষুধা লাগে না।

জেলা সিভিল সার্জন আনোয়ারুল আমিন আখন্দ জানান, ভম্বল শীল জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যাবে তত তাড়াতাড়িই সুস্থ হবেন তিনি।

আমারসংবাদ/জেআই