রকিব হোসেন॥প্রিন্ট সংস্করণ
আগস্ট ৮, ২০১৭, ০৫:৫৭ এএম
দেশীয় চলচ্চিত্রের কালজয়ী নায়ক প্রয়াত সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি, তাকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন এই হত্যা মামলারই সাত নম্বর আসামী রাবেয়া সুলতানা রুবি নামের আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশি। যদিও এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি বলে আসছিলেন, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়নি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এতে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি নির্দোষ। নিজের অবস্থান থেকে সরে এসে এবার রুবি একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন ভিন্ন কথা। ফলে অমর এই চিত্রনায়কের মৃত্যুরহস্য নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে।
গত রোববার নিজের ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিওতে রুবি বলেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি, তাকে খুন করা হয়েছে। প্রবাসী ওই নারীর মতে, সালমান হত্যার সাথে নায়কের স্ত্রী সামিরার পরিবার এবং রুবির স্বামীও জড়িত। রুবি বলেন, আমার হাজব্যান্ড (জন) এইটা করাইছে আমার ভাইরে দিয়ে। আমার হাজব্যান্ড করাইছে, এইটা সামিরার ফ্যামিলি করাইছে আমার হাজব্যান্ডরে দিয়ে, সবাইরে দিয়ে সব চাইনিজ মানুষ। সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই, সালমান শাহ খুন হইছে।
সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে ভিডিওতে রুবি আরও বলেছেন, ভাবী, আপনার ছেলেরে খুন করা হইছে। আমার যা করার আমি করবো, আমি ভেগে আছি ভাবী, নাইলে আমারেও মেরে ফেলতো এরা সবাই মিলে। লুসি, আমার হাজব্যান্ড জন, সবাই মিলে আমার বাচ্চাটা, আমার বাচ্চা রিকি আর আমার জানের ওপর অনেক জিনিস আছে ভাবী। দয়া করে কিছু করেন ভাবী, কিছু করেন। যেখানেই যান ইনভেস্টিগেশন করেন। এটা খুন ছিলো, ইমন আত্মহত্যা করে নাই। সালমান শাহ আত্মহত্যা করে নাই, আপনার ছেলেরে খুন করানো হইছে। আমার বাপরেও মনে হয় মাইরা ফেলছে ভাবি, আমি জানি না, আমার ভাইটারেও মাইরা ফেলছে মনে হয়। রুবির প্রকাশিত এই ভিডিও এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। রুবি দাবি করেছেন, তিনিই শেষ ব্যক্তি যিনি এই খুনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানেন। এ অবস্থায় সালমানের হত্যাকারীরা রুবির প্রাণনাশ করতে পারে বলে আতঙ্কিত এই নারী। ভিডিওতে রুবি আরও বলেন, আমি রুবি, এখানে ভেগে আসছি, এই কেস যেন না শেষ হয়। আমি যেভাবে পারি, ঠিকমত যেন আমি সাক্ষী দিতে পারি। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।
এদিকে রুবির প্রকাশিত ভিডিওবার্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনস (পিবিআই)। এজন্য তারা রুবির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) আবুল কালাম আজাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘রুবি ছিলেন সালমান শাহ’র বিউটিশিয়ান। সম্প্রতি তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। রুবির সঙ্গে আমরাও যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি দেশে নেই। এ কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তিনি যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ বলেন, সালমান শাহ হত্যা মামলাটি কয়েক পর্যায়ে তদন্ত হয়েছে। বর্তমানে এটি পিবিআই তদন্ত করছে। অনেক আলামতও নষ্ট হয়েছে। ফলে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
<iframe src="//www.youtube.com/embed/ZAsbVhTcWH0" width="600" height="400"></iframe>প্রসঙ্গত, নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ছিলেন শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ওরফে সালমান শাহ। মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনি দারুণ সাফল্য পেয়েছেন। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের রঙিন ভুবনে তার অভিষেক ঘটে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন মৌসুমী। সালমান শাহর প্রথম ছবি সুপার ডুপার হিট করে। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে সুখের এক সংসার ছিলো তার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সালমানের জীবনে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চলচ্চিত্রে যখন তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়, ঠিক তখনি ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই তার মৃত্যুর খবরে গোটা বাংলাদেশ যেন শোকের সাগরে ভাসে। নায়কের ঘর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ধারণা করা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু সালমান শাহের পরিবারের দাবি, তাদের সন্তানকে খুন করা হয়েছে। রহস্যজনক এ মৃত্যুর ঘটনায় সে সময় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন নায়কের বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী।
পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকান্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। এতে সালমান শাহের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী রিভিশন মামলা করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। এরপর প্রায় ১২ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সালমান শাহের মা নীলুফার চৌধুরী ছেলের মৃত্যুতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেবেন বলে আবেদন করেন। পরে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলুফার চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের নারাজির আবেদন দাখিল করেন। নারাজি আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার ছেলে সালমান শাহের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। আদালত নারাজি আবেদনটি মঞ্জুর করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) তদন্তভার প্রদান করেন। মামলাটিতে র্যাবকে তদন্ত দেয়ার আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত একই বছরের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ-৬ এর বিচারক ইমরুল কায়েস রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এবং র্যাব মামলাটি আর তদন্ত করতে পারবে না বলে আদেশ দেন। ঘটনার ২০ বছর পর আলোচিত ওই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআইকে।
সালমানের শ্বশুর হিরা যা বললেন : ফেসবুকে প্রকাশিত রুবির ভিডিওবার্তা সবার মতো প্রয়াত সালমান শাহের শ্বশুর জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক শফিকুল হক হীরাও দেখেছেন। এতে নিজের বিরুদ্ধে রুবির অভিযোগকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভিডিওটি আমিও দেখেছি। এটা খুবই হাস্যকর লেগেছে। আমি জেনেছি রুবি তার স্বামীর সঙ্গে নেই। ওদের ডিভোর্স হয়েছে। শেষ বয়সে অর্থকড়ির ঝামেলায় আছে হয়তো। কারণ ডিভোর্সের সময় স্বামীর কাছ থেকে টাকা নিতে পারেনি, তার ও পুত্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এজন্য মাথা হয়তো বিগড়ে গেছে। কিন্তু তার দায় তো দেশ ও জাতি নেবে না। তিনি আরও বলেন, ‘ও নিঃস্ব অবস্থায় আছে। তাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যা খুশি তাই করছে। হতে পারে সালমানের মা ওকে টাকার লোভ দেখিয়ে থাকতে পারে। সেজন্যই একটা পুরোনো ইস্যুকে নতুন করে রঙ মাখিয়ে হাজির করেছে। হীরা আরও বলেন, ‘ও নিজেই তো এই মামলার আসামি। ঘটনার শুরু থেকেই সে সমালোচিত। কিন্তু বরাবরই সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছে। সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করে সালমানের মাকে কটাক্ষ করেছে। তবে নতুন করে কেনো সে এই মিথ্যাচার করছে, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমার মেয়ে বা আমার পরিবার সালমানের হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ, অনেক আগেই আদালত এটা প্রমাণ করেছেন যে, সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছিল।
সালমানের মা নীলা চৌধুরীর বক্তব্য : সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে বলে রাবেয়া সুলতানা রুবির স্বীকারোক্তির প্রসঙ্গ টেনে প্রয়াত এই চিত্রনায়কের মা নীলা চৌধুরী দেশবাসীকে তার সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। গতকাল সোমবার দুপুরে ফেসবুকে নীলা চৌধুরী লিখেছেন, প্রিয় দেশবাসী। আমাকে সাহায্য করুন। দেখুন, রুবির স্বীকারোক্তি। কীভাবে সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। যেভাবে পারেন এফবিআইকে জানান, বাংলাদেশের সকল চ্যানেলকে অনুরোধ করছি, রুবির স্বীকারোক্তিটা চালিয়ে দেন। জানা গেছে, নীলা চৌধুরী এখন লন্ডনে আছেন, সালমান শাহ’র ছোট ভাই শাহরানের কাছে। নীলা আরও লিখেছেন, ‘প্রিয়জন, খেয়াল রাখবেন এই নিউজের পর অনেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে। শান্তভাবে কাজ করবে। সবাইকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘সালমানের স্ত্রী সামিরা ও তার পরিবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কোনোভাবেই যেন তারা ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়তে না পারে। তিনি রুবিকে অনুরোধ করে বলেন, রুবি, তুমি এত কথা বলতে পারছ, তাহলে এফবিআই বা পুলিশকে ফোন দাও। ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে জানাতে পারছ না? তোমাকে সেফ করতে বলো।
কে এই রুবি : রাবেয়া সুলতানা রুবি ছিলেন প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ’র বিউটিশিয়ান। সালমান শাহ্ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিও তিনি। জানা গেছে, রুবি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় অবস্থান করছেন। ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, ‘জীবন হারানোর আশঙ্কা করছেন তিনি। তিনিই নাকি একমাত্র জীবিত মানুষ, যার কাছে প্রমাণ আছে সালমানকে খুন করা হয়েছে। তাই তাকেও মেরে ফেলা হতে পারে। সূত্র জানায়, রুবি থাকতেন সালমান শাহর ফ্ল্যাটের উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ে। তিনি রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রশিদের মেয়ে। প্রয়াত ক্যাপ্টেন জামিল ছিলেন তার স্বামী। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর যে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়, তার স্বামী ছিলেন তাদের একজন। ক্যাপ্টেন জামিলের সংসারে জন্ম নেওয়া পুত্র ভিকিকে নিয়ে ৩১ বছর আগে তিনি চীনের এক নাগরিককে বিয়ে করেন। সালমানের মৃত্যুর কয়েক বছর পর রুবি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করছেন তিনি। সাংবাদিক সুপন রায়ের লেখা ‘সালমান শাহর অজানা কথা’ বইতে উল্লেখ আছে- সুষ্পষ্ট অভিযোগ আছে, সালমান-সামিরার দাস্পত্য কলহের পশ্চাতে রাবেয়া সুলতানা রুবির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। সালমানকে তিনি দেখে নেবেন, এরকম কথাও বলেছেন অনেকের কাছে। জাদুশিল্পী আজরা জ্যাবিনের কাছে এই রুবি বলেছিলেন, ‘সালমানের সব টাকা তার মা নিয়ে যাচ্ছে, সামিরার কি হবে? এবং এ অভিযোগটি করেছেন সালমানের মা নীলা চৌধুরী। তার ভাষ্য, আমার ছেলের টাকা আমি নিলাম না তার বাবা নিল-এসব নিয়ে রুবির মাথা ব্যথা কেন? রুবি কে, যে আমার সংসার জীবনে হস্তক্ষেপ করবে?