Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৬ মে, ২০২৫,

কোটি কোটি টাকা ক্যাশিং করে হুন্ডি ব্যবসা

প্রিন্ট সংস্করণ॥আব্দুল লতিফ রানা

জানুয়ারি ৫, ২০১৮, ০৫:৫৯ এএম


কোটি কোটি টাকা ক্যাশিং করে হুন্ডি ব্যবসা

রেমিট্যান্সের অর্থ বিকাশে ক্যাশিং করে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে। প্রতি মুহূর্র্তে ৬০টি ক্যাশিং করার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ক্যাশিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করার সঙ্গে জড়িত ৭ জনকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- রাজশাহীর মো. মান্নান, পাবনার সংগীত কুমার পাল, মো. আমিনুল হক, মো. মোজাম্মেল মোল্লা, মো. হোসেন আলী, চট্টগ্রামের মো. দিদারুল হক ও ময়মনসিংহের আবু বকর সিদ্দিক। এসব ঘটনায় বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডি করে টাকাপাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর হুন্ডির কাজে বিভিন্ন কাগজপত্র, সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। 

গত বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানি লন্ডারিং মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল জানান, দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি বিভাগে এক প্রতিবেদন তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ওই প্রতিবেদনটি বিস্তারিত অনুসন্ধান করে জানতে পারে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র রেমিট্যান্স কমানোর পেছনে কাজ করছে। এ চক্রটি অবৈধ হুন্ডি তৎপরতার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। ওই হুন্ডি চক্রের কিছু সদস্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে বাংলাদেশি ওয়েজ আর্নারদের নিকট হতে বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণপূর্বক তা বৈধ পথে বাংলাদেশে না পাঠিয়ে এ অর্থের মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করছে। আর অর্থ প্রদানে বিকাশের হিসাব ব্যবহার করছে। রেমিট্যান্স অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ প্রক্রিয়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা মতে মানি লন্ডারিং অপরাধ। সিআইডি পুলিশ এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে অর্গানাইজড ক্রাইমের কয়েকটি চৌকষ দল দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ৭ জন হুন্ডিকারী বিকাশের এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে।
সংশ্লিষ্ট ধারায় এদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করা হয়। এই চক্রের বেশ কয়েকজন সিআইডির তৎপরতার বিষয়টি জানতে পেয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে। আর এখনো বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি আরো জানান, হুন্ডি ব্যবসায়ী প্রযুক্তির মাধ্যমে মুহূর্র্তের মধ্যেই কোটি কোটি টাকার ক্যাশিং করছে। আমরা একটি ঘটনায় এক মুহূর্র্তে ৬০টি ক্যাশিং করার প্রমাণ পেয়েছি। ২৮ বিকাশ এজেন্টের তালিকা থেকে ২৫টি এজেন্টকে সনাক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর একজন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে পালিয়ে গেছে। এসব চক্র অবৈধভাবে বিকাশের মাধ্যমে ক্যাশিং করে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এতে বাংলাদেশ সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সিআইডির সূত্র জানায়, বিকাশ এজেন্টরা হুন্ডির মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করছে। সিআইডির অর্গানাইজড টিম ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত টেকনাফের কক্সবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন নুরুল হক ওরফে ভুট্টো ও মো. সালাহ উদ্দিন। গ্রেপ্তারকৃতদের বিকাশ নম্বর থেকেই ১০ লাখ ৩০ হাজার আর অপর এক নম্বর থেকে ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা অল্প সময়ে হুন্ডি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকাপাচারের ঘটনা থামছেই না। সরকারের দায়িত্বশীল প্রায় আটটি সংস্থার ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না হুন্ডিবাণিজ্য। আর অর্থপাচারের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বিদেশ গমন, চিকিৎসাব্যয় মেটানো, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, বৈদেশিক কেনাকাটা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্র এখন হুন্ডির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা লেনদেন সহজীকরণ, ব্যাংকগুলোর নানা সেবামূলক ব্যবস্থাপনাও হুন্ডি বাণিজ্যকে রোধ করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপাচারের প্রধান উপায়ই হচ্ছে হুন্ডি। দেশে হুন্ডি ক্রমেই ব্যাপক হচ্ছে। এমনকি হুন্ডিবাণিজ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করায় ভারত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে টাকা পাঠানোর পদ্ধতিও চালু করেছে সম্প্রতি। এসব টাকা হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন চোরাচালানে ব্যবহার করে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করেও দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার করছেন।
আরেক সূত্র জানায়, গত ৩০ বছরে রাষ্ট্রের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। লুটেরা চক্রের সদস্যরা হুন্ডির মাধ্যমেই এ অর্থ লুটে নিয়ে মালায়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। শুধু তাই নয়, অনেকেই ইউরোপের দেশে দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য করছে।
বিদেশি প্রতারকদের সঙ্গে মিলেমিশে এদেশি সহযোগীরা দফায় দফায় নানা কায়দা-কৌশলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরেক চক্র সীমাহীন প্রতারণার বেড়াজালে লুটে নিয়েছে ব্যাংকগুলোর টাকা। একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সেসব টাকা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে ভিন্ন দেশে।
অন্য এক সূত্র জানায়, একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি অবৈধভাবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা নরওয়েতে পাচার করেছে। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করলেও রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আর অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর বিভিন্ন চক্র অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। বিদেশিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ভিওআইপি চক্র টাকাপাচার করে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। শুধু তাই নয়, দেশে গজিয়ে ওঠা ৩৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও প্রতি বছর দেদার টাকা বাইরে যাচ্ছে, এর সিংহভাগই পাঠানো হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।
মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় হুন্ডির ব্যবসা চালানো হচ্ছে। একের পর এক মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধ করেও প্রতিষ্ঠানগুলোর হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র মতে, বেশিরভাগ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানকে সোনা চোরাচালানে অর্থের জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে তারা ডলারপাচার করছে বলেও জানা গেছে। আর হুন্ডি ব্যবসার আড়ালে মানবপাচারও করা হচ্ছে। রাজধানীর পল্টন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ কয়েক বছর আগে মিঠুন আকন ও আরফান নামের দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।এ ঘটনার তদন্তে চক্রটির হুন্ডি ব্যবসার আড়ালে মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পায় সিআইডি। সিআইডির সিনিয়র সহকারী কমিশনার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া সেল) শারমিন জাহান গতকাল বিকাশে হুন্ডি করার অভিযোগে ৭ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, রেমিট্যান্সের অর্থ জালিয়াতির কারণে দায়ের করা ৯টি মানিলন্ডারিং মামলায় এ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।