প্রিন্ট সংস্করণ॥ আব্দুল লতিফ রানা
ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৮, ০৭:১৯ পিএম
মিরপুরের সেই ‘ভূ তের বাড়ি’ এখন আর ভুতুড়ে অবস্থায় নেই। অনবরত ঠুক-ঠাক, ঠুস-ঠাস কাঠুরেদের হাতুড়ের বাড়ির শব্দ চলছে। আর এই শব্দের কারণেই ভূতেরা সব পালিয়েছে। বাড়িটির উত্তর পাশের কিছু অংশে গাছ-গাছালি, আর দক্ষিণ পাশসহ পুরো বাড়িতে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। আগে এই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দিনের বেলাও ভয় পেতো প্রতিবেশীরা। এমনকি বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতেও পথচারীরা ভয় পেতো। এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই। বাড়ির ভেতরে কাঠমিস্ত্রিরা কাজ করছেন। গাছ-গাছালি থাকলেও আগের মতো নেই। তাই এখন আর বাড়িটিতে ভূতের গন্ধ নেই। বাড়ির পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এখন ভূতের বাড়িটির জায়গায় আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি করা হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ৯ নম্বর সড়কের এ বাড়ির জায়গায় এখন একটি হাউজিং কোম্পানির মাধ্যমে বাড়ি করা হচ্ছে। এর আগে জায়গাটি দখলের জন্য একাধিক চক্র উঠেপড়ে লেগেছিল। দুই বিদূষী নারী সিজোফ্রোনিয়ায় আক্রান্ত অবস্থায় উদ্ধার এবং চিকিৎসা নিয়ে দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত ফলাও করে সংবাদ প্রচার করে। এরপর থেকে ওই চক্রটি কিছুটা পিছটান দিলেও তাদের চোখ এখনো ফিরিয়ে নেয়নি। তবে শিগগিরই সেখানে একটি হাউজিং কোম্পানি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করবে। এজন্য জায়গার প্রকৃত মালিক ডা. আইনুন নাহার ওরফে রিতা, প্রকৌশলী নুরুন্নাহার ওরফে মিতা ও তাদের বড় বোন হেনার সঙ্গে চুক্তিও করা হয়েছে। শিগগিরই ওই হাউজিং কোম্পানি সেখানে কাজ শুরু করবে। সরেজমিন দেখা যায়, বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের গেট দিয়ে প্রবেশ করার রাস্তাটিও আবর্জনায় সয়লাব। আর দক্ষিণ পাশের টিনসেড ঘরের ৩টি রুম এবং পূর্ব পাশের রুমগুলোতে ফার্নিচারের কাজ চলছে। এ আলোচিত ভূতের বাড়ির বাসিন্দা ছিল সিজোফ্রোনিয়া রোগে আক্রান্ত বিদূষী দুই নারী ডা. আইনুন নাহার ওরফে রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতা। রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ৯ নম্বর সড়কে ‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিত তাদের নিজ বাড়ি থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় একটি মানবাধিকার সংস্থা গত ২০০৫ সালের ১৩ জুলাই তাদের উদ্ধার করে। এরপর তাদের মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসার পর কয়েক বছর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগ সিজোফ্রোনিয়ায় আবার আক্রান্ত হন রিতা ও মিতা। তবে এখন পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় তাদের বড় বোন হেনা আক্তারের রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার বাসায় অবস্থান করছেন বলে জানাগেছে। গতকাল মিরপুরে ডাক্তার আইনুন নাহার রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতা ও হেনাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ভেতরে কাঠমিস্ত্রিরা কাঠ কাটছেন। ছয়-সাতজন কাঠমিস্ত্রি একেকজন একেক ধরনের কাজ করছেন। বাড়ির ভেতের গিয়ে দেখা যায়, জঙ্গল, ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে। বাড়ির গেটের সামনে একটি সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে লেখা– ডা. আইনুন নাহার (রীতা). এমবিবিএস, পিজিটি (গাইনি), সাবেক মেডিকেল অফিসার, বিএসএমএমইউ, ঢাকা, সাক্ষাতের সময় বিকাল ৫টা-রাত ৮টা, শুক্রবার বন্ধ, সেকশন-৬ রোড-৯ মিরপুর, ঢাকা। বাড়ির সামনের দিকের প্রধান সড়কের দুটি ফার্নিচারের দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দোকানের মালিকই বাড়িটির ভেতরে কর্মচারী রেখে ফার্নিচারের কাজ করাচ্ছেন। আর বাড়ির সামনের দেয়ালের সঙ্গে একটি টংয়ের মতো ভ্যানগাড়ির ভেতরে সৈয়দ হোসেন আলী নামের এক ব্যক্তি চা-সিগারেটের দোকান দিয়েছেন। তিনি ওই বাড়িটি দেখাশোনা করেন।
গতকাল রোববার সকালে সৈয়দ হোসেন আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বাড়িটির মালিক তিন বোন। তাদের মধ্যে বড় বোন হেনা আক্তার মাঝে মধ্যে আসেন। আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজখবর রাখেন। তিনি রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায় তার স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। আর তার দুই বোন ডা. আইনুন নাহার রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহান মিতাকেও তার সঙ্গেই রেখেছেন। তারা দুই বোন এখন পরিপূর্ণ সুস্থ আছেন। সুস্থতার সঙ্গেই জীবন যাপন করছেন বলে হেনা আক্তার তাকে জানিয়েছেন। তবে হেনা আক্তারের বাসার ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর জানাতে পারেননি। স্থানীয় এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১৯৮২ সালে হেনা-রিতা-মিতার বাবা শরফুদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া মারা যান। আর ২০০৩ সালে মা রওশন আরা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে রিতা-মিতা মিরপুরে তাদের মায়ের বাড়িতে থাকতেন। ডা. আইনুন্নাহার রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতাকে তাদের বড় বোন হেনা আক্তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এতে বড় বোনের প্রতি তারা ক্ষীপ্ত হতেন। ১৯৯৪ সালে তাদের বড় বোন হেনা আক্তারের বিয়ে হয়। তার বিয়ের পর থেকেই তাদের দুই বোনের চাল-চলনে অস্বাভাবিক অবস্থা বোঝা যেত। আর তাদের বোনের স্বামীকেও তারা এড়িয়ে চলতেন। অপর সূত্র জানায়, মিরপুরে সাড়ে সাত কাঠা জমির ওপর বাড়ি ও দুটি দোকান রয়েছে রিতা-মিতার মায়ের নামে। বাড়িটি উডল্যান্ড প্রতিষ্ঠানের মালিক ও একটি স্কুলের শিক্ষকসহ কয়েক ব্যক্তি দখলের জন্য নানা চেষ্টা চালিয়েছিলো। আর তিন বোনের মায়ের সম্পত্তি আঁকড়ে ধরে বছরের পর বছর নিজ বাড়িতে মানসিক ভারসাম্যহীন জীবন যাপন করতেন রিতা ও মিতা।