জানুয়ারি ১, ২০১৬, ১০:২৭ এএম
আগামী ১২ জানুয়ারি ২০১৬ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। মহুয়া আর চন্দ্র মল্লিকার সৌরভে সুরভিত এ ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে কেন্দ্র করে এ্যালামনাই ডে ও মিলনমেলাসহ ৪ দিনের বর্ণিল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ। সেই আলোকে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ থাকলেও আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে ৫০ একর ছেড়ে দেওয়ার ফলে বর্তমানে এর পরিমান দাঁড়ায় ৬৯৭.৫৬ একর। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ থেকেই ১৯৭০ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি কেঁটে এর নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস.এম আহসান।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমে মাত্র ৪টি বিভাগ ২১ জন শিক্ষক আর ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও ২ টি ইন্সটিটিউটে সাত'শ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর বসবাস।
১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন। বর্তমান উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম, যিনি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২০১৪ সালের ২ মার্চ থেকে দায়িত্বরত আছেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে। যাদের মধ্যে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক অন্যতম।
এছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ইতিহাসবিদ এ কে এম শাহনাওয়াজ প্রমুখ বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপিতহয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিভাগের অধীনে উয়ারী বটেশ্বরে খননকার্য চালানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা এখান থেকে এম.ফিল ও পি.এইচ.ডি গবেষণা করতে পারে। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’।
বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ আবাসিক। মোট ১৩টি আবাসিক হল চালু আছে। এছাড়াও নির্মানাধীন রয়েছে ৩টি হল। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোন না কোন হলে আবাসিকের ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার খুবই সমৃদ্ধ। গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ১ লাখ বই আছে। তাছাড়া গ্রন্থাগারসহ প্রায় প্রতিটি ভবনে রয়েছে ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সুবিধা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির লেক। শীতের মৌসুমে প্রচুর অতিথি পাখি আসে এখানে। অতিথি পাখিদের শুভেচ্ছা জানাতে লেকগুলোতে ফুটে ওঠে হাজারও লাল শাপলা। তারই মধ্যে পাখিদের উড়াউড়ি আর জলকলির দৃশ্য মুগ্ধ করে দেশি-বিদেশি দর্শণার্থীদের। তাছাড়া ষড় ঋতুর এদেশে ঋতু পরিবর্তনে ক্যাম্পাসের প্রাকৃডুশ সৌন্দর্য সকলকে আকৃষ্ট করে। প্রজাপতির সংরক্ষন ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ‘প্রজাপতি পার্ক’। প্রতিবছর নানা আয়াজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় 'প্রজাপতি মেলা'।
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দয্যের লীলাভূমি খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামেও পরিচিত। বছরব্যাপী নাটক, বিতর্ক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীতানুষ্ঠানসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকা- লেগেই থাকে। যার ফলে গড়ে উঠেছে শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। আর সংস্কৃতি চর্চাকে কেন্দ্রকরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ’। বিকেলে মুক্তমঞ্চ, খেলার মাঠ, ক্যাফেটেরিয়া চত্বর, টার্জেন্ট পয়েন্ট, শহীদ মিনার, অমর একুশের পাদদেশসহ প্রভৃতি স্থানে জমে উঠে আড্ডা ও গানের আসর। শুধু লেখা-পড়া আর আড্ডার মধ্য সীমাবদ্ধ নয় খেলাধুলাতেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে একক আধিপত্য। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য মুশফিকুর রহিম যার অন্যতম উদাহরণ। এছাড়াও অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি, জাকিয়া বারি মম, বিদ্যা সিনহা মীম, সুমাইয়া শিমু প্রমুখ ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘অমর একুশে’ ভাষ্কর্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে হাত-পা হারানো দেশের বীর সন্তানদের শ্রদ্ধায় নির্মান করা হয়েছে স্মারক ভাষ্কর্য ‘সংশপ্তক’।
বিভিন্ন জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করেন। এরশাদ সরকারের আমলে শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনেও শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মানিক ও তার সঙ্গীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত হয়। পূণরায় প্রত্যাবর্তন করলে ১৯৯৯ সালে শিক্ষার্থীদের এক অভ্যুত্থানে ওই অভিযুক্তরা পূণরায় বিতাড়িত হয়। এই আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন বলে পরিচিত।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার পাশাপাশি রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হওয়া সত্ত্বেও তীব্র সিট সঙ্কট চলছে হলগুলোতে। সময়োপযোগী অনেক বিভাগ এখনও চালু হয়নি। আধুনিকতার ছায়া পায়নি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী। তাছাড়া প্রায়ই দেখা যায় রাজনৈতিক দলাদলি আর হানাহানি। এধরনের নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিদেশে তার দৃষ্টান্ত রেখে আসছে। জ্ঞানের শিখা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ব ভূম-লে।