Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

বেরোবিতে দুর্নীতির খবর ঢাকতে উপেক্ষিত তথ্য অধিকার আইন

ইভান চৌধুরী, বেরোবি

নভেম্বর ২৭, ২০২০, ০৮:৪০ এএম


বেরোবিতে দুর্নীতির খবর ঢাকতে উপেক্ষিত তথ্য অধিকার আইন

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) দুর্নীতির খবর ঢাকতে উপেক্ষিত হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন। গণমাধ্যম কর্মীসহ সমাজিক ও সাংস্কৃতিক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কেউই কোন তথ্য পাচ্ছেন না। এমনকি তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করেও কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।  
 
২০১৭ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। নিয়োগ প্রাপ্তির প্রথম থেকেই গণমাধ্যম কর্মীদের এড়িয়ে চলেছেন তিনি। কিছুদিন পর উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে সংবাদ কর্মীদের সাক্ষাৎ দিতে পুরোপুরিই অস্বীকৃতি জানান উপাচার্য। একইসঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলাও বন্ধ করে দেন তিনি। পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য দপ্তরগুলোও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে অনীহা দেখাতে থাকে। দপ্তরগুলোতে তথ্য চাইলে উপর মহলের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন কথা বলে তারা এড়িয়ে যান। 

একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অভিযোগ, দাপ্তরিক তথ্য সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হয়রানি করেছে প্রশাসন। তাদের অনেককে প্রায় বিনা কারণেই মাসের পর মাস সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে। অনেকেই উচ্চ আদালত থেকে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার পূর্বক চাকরিতে যোগদানের রায় পেলেও তাদেরকে যোগদান করতে দেওয়া হচ্ছে না। 

রংপুরের বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল নিয়োগ, ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি, অভ্যন্তরীন কেনাকাটা ও প্রশাসনিক-আর্থিক কর্মকান্ডে বিভিন্ন সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কিংবা শাখা প্রধানদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তারা সরাসরি উপাচার্য বা রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। উপাচার্য ও রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে অধিকাংশ দিনই তাদের কাউকেই পাওয়া যায় না। এই দুই কর্তাব্যক্তির মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তারা তা রিসিভ করেন না। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেন না উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, নিয়োগ প্রাপ্তির পর ৯০ শতাংশ দিনই ক্যাম্পাসে আসেননি বেরোবি উপাচার্য। অভিযোগ রয়েছে রেজিস্ট্রার আবু হেনা মোস্তাফা কামালও অফিসে আসেন না। তারা ঢাকায় বসে অনেকটা অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। 

এমতাবস্থায় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত অধিকাংশ সংবাদে উপাচার্য, উপ উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের কোনো বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয় না। প্রকাশিত অধিকাংশ খবরে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্টদের তথ্য প্রদানে অনীহার বিষয়টি উঠে আসে। এমনকি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তথ্য না পেয়ে গতবছর সিনিয়র একজন সাংবাদিক তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু তাতেও গড়িমশি করে প্রশাসন। 

এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক এর রংপুর মহানগরের সভাপতি ফখরুল আনাম বেনজু গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করেন। প্রশাসন নির্দিষ্ট সময়ে তথ্য না দিলে তিনি তথ্য কমিশনে আপিল করেন, তারপরেও তথ্য না পেয়ে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেন তিনি। এরপর একদিনের সময় নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তীতে এর শুনানি হলে, সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রার্থীর চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করে চিঠি দেয় তথ্য কমিশন। পরে প্রশাসন ফখরুল আনাম বেনজুকে আংশিক তথ্য প্রদান করেন। যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা আবেদনের তুলনায় আংশিক এবং এতে সন্তুষ্ট নয় উল্লেখ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও তথ্য কমিশনে আবেদন করেন তিনি। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি মাসের ৩০ নভেম্বর আবার শুনানি তারিখ নির্ধারণ করেছে কমিশন।

এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেনজু বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করি। নানান টালবাহানা শেষে প্রশাসন আমাকে আংশিক তথ্য প্রদান করে। তবে আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। আমি আবার তথ্য কমিশনে আবেদন করেছি। এখানে তথ্য অধিকার আইন উপেক্ষিত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। 

তথ্য কুক্ষিগত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র। 

সূত্র মতে, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে তাদের দুর্নীতির তথ্য যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য দপ্তরগুলোর উপর অঘোষিতভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ উপাচার্য হিসাবে যোগদানের কিছুদিন পরই বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে সিনিয়র শিক্ষকদের সরিয়ে দিয়ে তুলনামূলক জুনিয়র শিক্ষকদের অধিকাংশ প্রশাসনিক পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দেন। চলতি দায়িত্ব পালন করা এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি দায়িত্ব দেওয়া জাস্ট আই ওয়াশ। চলতি দায়িত্ব দিয়ে উপাচার্য মূলত দপ্তরের সার্বিক ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখেন। যারা চলতি দায়িত্বে থাকেন তাদের সাইনিং পাওয়ার ছাড়া কার্যত আর কোনো ক্ষমতা থাকে না। তারা নিজেরা দপ্তরের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। এমনকি দপ্তর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা সংবাদমাধ্যমে কথা বলার স্বাধীনতাও রাখেন না। 

সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংবাদমাধ্যমে উপাচার্যের কোনো বক্তব্য পায়নি সংবাদ কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তথ্য গোপন রেখে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করছে বেরোবি প্রশাসন। 

সকল দুর্নীতি ও অনিয়ম লোকচক্ষুর আড়াল করতেই মূলত প্রশাসন তথ্য গোপন রাখছে। প্রশাসন সৎ থাকলে অবশ্যই তথ্য প্রদান করতেন বলে মন্তব্য করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদিক সমিতির সভাপতি মোবাশ্বের আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশ ও বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনেক। কিন্তু বর্তমান বেরোবি প্রশাসন সাংবাদিকদের কোন রকম তথ্য দিতে চায় না। তথ্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ মূলত প্রশাসনের হীনমানসিকতার পরিচয়। প্রশাসনের উচিত সাংবাদিকদের তথ্য প্রদান করা যাতে করে সাংবাদিকরা সবার সামনে সবকিছু সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারে।

এ বিষয়ে দৈনিক সংবাদের রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি লিয়াকত আলী বাদল বলেন, তথ্য নিতে দপ্তরগুলোতে গেলে দপ্তর সংশ্লিষ্টরা উপাচার্যের কাছে নিতে বলেন। কিন্তু উপাচার্যের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায় না। পরে ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন না। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণিত বিভাগের শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, মূলত বর্তমান উপাচার্য তার দুর্নীতি ঢাকতেই তথ্য গোপন করছে। সংবাদকর্মীরা হচ্ছে সমাজের আয়না, তারা তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। 

সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য উপাচার্য, উপ উপাচার্য, ট্রেজারার ও রেজিস্টারের কার্যালয়ে গিয়ে তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। পরে তাদের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালে, ফিরতি কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

আমারসংবাদ/কেএস