Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে ভিসির দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

ইভান চৌধুরী, বেরোবি প্রতিনিধি

মার্চ ২, ২০২১, ০৯:৪০ এএম


প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে ভিসির দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘বিশেষ  উন্নয়ন প্রকল্প’ শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটসহ স্বাধীনতা স্মারকের নির্মাণ কাজে ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সরেজমিন তদন্ত কমিটি। 

এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, ১৪ জুন ২০১৭ সালে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ চতুর্থ ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ তদারকি করার জন্য উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস কমিটি সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদের ওই দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড এর স্বত্বাধিকারী। 

কিছুদিন পর আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিব ও প্রকৃত নির্মাণ লিমিটেড এর কার্যাদেশ বাতিল করে প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে দ্বিতীয় পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিবকে নানাভাবে ভয়ভীতিও প্রদর্শন করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অনুমোদিত ডিপিপির তোয়াক্কা না করেই ভবন দুটির (শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) নকশা পরিবর্তন করা হয়। পাশাপাশি নির্মাণে ব্যয় বাড়ানো হয় দুই গুণেরও বেশি। ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভবনে নির্মাণ ব্যয় ২৬ কোটি ৮৭ লাখ থেকে বাড়িয়ে ব্যয় ধরা হয় ৬১ কোটি টাকা।

আর  ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১০৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে মূল ডিপিপিতে পরামর্শক ফি না থাকলেও বর্তমান ভিসি সেই খাতে ব্যয় করেছেন ৪০ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন নিয়মই মানেনি ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অসংগতি নজরে এলে ইউজিসিকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। 

এরপর গত বছরের ২০ এপ্রিল ইউজিসির সদস্য মুহাম্মদ আলমগীরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক (বর্তমানে সচিব) ফেরদৌস জামান এবং ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক দুর্গা রানী সরকার।

এক বছর পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সরেজমিন পরিদর্শনে আসে এই তদন্ত কমিটি। পরিদর্শনকালে তারা বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণাধীন স্থাপনাসহ প্রকল্পের কাগজপত্রাদি যাচাই বাছাই করেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় এই তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি স্থাপনা নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জয়েন্ট ভেঞ্চার অব আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবীব এন্ড প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের সাথে সমঝোতা না করে প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ কর্তৃক দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স একিউম্যান আর্কিট্যাক্ট এন্ড প্লানার্স লিমিটেডকে নিয়োগ প্রদান করা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট ২০০৬, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮ এবং প্রকল্প পরিচালকের সাথে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চুক্তির নিয়মাবলীর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে কমিটি মনে করে।

প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য প্রকৃত নকশা বা ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তাছাড়া ইতোমধ্যে উক্ত ভবনটির অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তাই এখানে দ্বিতীয় ড্রয়িং বা ডিজাইনের কোন ধরনের প্রয়োজন আছে বলে কমিটি মনে করে না। 

বর্তমান পরিস্থিতি যা হোক না কেন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মূলধন ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা উচিত। সরকারি উপেক্ষা করে অযাচিতভাবে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কার্যাদেশ প্রদান করা হয় যা সরকারি ক্রয় পদ্ধতি নিয়ম বহির্ভূত। এ ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা  গ্রহণ করা যেতে পারে।

স্বাধীনতা স্মারকের অসমাপ্ত কাজ কিভাবে সম্পন্ন করা হবে তা সুষ্ঠু সমাধান মূল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবিবই করতে পারবেন। বর্তমানে আর্কিটেক্ট মঞ্জুর কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ওয়ার্কস কমিটির সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত আছেন। 

এই সময়ে দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মেসার্স একিউম্যান আর্কিটেক্ট এন্ড প্লানার্স লিমিটেড ভবন সংশোধিত ড্রয়িং বা ডিজাইন প্রণয়ন করে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক উপাচার্যের নিকট থেকে অনুমোদন নিয়েছেন। 

এই সময়ে আর্কিটেক্ট মঞ্জুর কাদের পরিকল্পনা উন্নয়ন, ওয়ার্কস কমিটির সদস্য থাকা সত্বেও এরকম একটি অগ্রহণযোগ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ ড্রয়িং বা ডিজাইন অনুমোদিত হয়েছে। তাই তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আর্কিটেক্ট মঞ্জুর কাদেরকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রয়োজন।

দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদানকৃত দুটি ভবনের যথাক্রমে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড্রয়িং বা ডিজাইনের এরিয়া এক হলেও আরডিপিপিতে দুটি ভবনের অতিরিক্ত এরিয়ার অনুকূলে অর্থ প্রাক্কলন করে প্রকল্প পরিচালক ও উপাচার্যের স্বাক্ষরসহ ইউজিসিতে প্রেরণ করা হয়েছে। 

দুটি ভবনের এরিয়া এক থাকা সত্বেও অতিরিক্ত এরিয়া ও অতিরিক্ত  প্রাক্কলন ব্যয়সহ আরডিপিপি প্রণয়ন করা নৈতিক বিচ্যুতি। যেহেতু প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও আর্কিটেক্ট মনোয়ার হাবীব ড্রয়িং বা ডিজাইনের উপর তিনটি অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান। তাই তার এবং উক্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে অবশিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অবকাঠামো নির্মাণে যে অবহেলা, দীর্ঘসূত্রতা ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বর্তমান প্রশাসনের অনৈতিকতা, অদক্ষতা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং শিক্ষা গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধান এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকার জন্য বর্তমান উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর এই দায়দায়িত্ব অবশ্যই বহন করা উচিত। একই সঙ্গে ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবনের নকশা পরিদর্শন করে যেভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।   

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর উন নবীর আমলে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের ১০ তলা ভবন ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ১০ তলা ভবনের কাজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে ‘স্বাধীনতা স্মারক’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ এখনো অর্ধেকও হয়নি।

আমারসংবাদ/এআই