Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

অকালেই নিভে গেছে বাংলা সিনেমার যে নক্ষত্রগুলো

মার্চ ২৫, ২০২১, ০৬:০৫ এএম


অকালেই নিভে গেছে বাংলা সিনেমার যে নক্ষত্রগুলো

বাংলা সিনেমা জগতকে রাঙিয়ে গেছেন অনেক তারকরা। নিজেদের অভিনয় গুণে জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকদের মনে। কিন্তু এমন কিছু তারকা আছেন যারা চলচ্চিত্র জগতে এসেছিলেন ইতিহাস গড়ার জন্যে। যে কারণে মৃত্যুর পরও আজও উজ্জ্বল সেই অকালে নিভে যাওয়া তারকারা। 

আমার সংবাদের আজকের প্রতিবেদন সেই অকালে নিভে যাওয়া তারকাদের নিয়ে--  

জসিম: আশির দশকের একজন জনপ্রিয় নায়ক জসিম। এই অভিনেতা ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অ্যাকশন দৃশ্যে জসিম এনেছিলেন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।অনেকেই তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের অ্যাকশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে মনে করেন। তিনি একাধারে একজন অভিনেতা, প্রযোজক, ফাইট ডিরেক্টর ও একজন মুক্তিযোদ্ধা। খলনায়ক চরিত্র দিয়ে সিনেমা জগতে অভিষেক হয়েছিল তার। কিন্তু নিজ দক্ষতায় জায়গা করে নেন সফল নায়কদের নামের তালিকায়।

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত দোস্ত দুশমন চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করেন তিনি। দোস্ত দুশমন সিনেমাটি সাড়াজাগানো হিন্দি চলচ্চিত্র শোলের পুনর্নিমাণ। সিনেমায় তিনি গাফফার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন খোদ শোলে সিনেমার নামকরা চরিত্র গব্বার সিং এর আদলে থাকা ভারতীয় খলনায়ক আমজাদ খান পর্যন্ত ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন জসিমের। তার খলনায়ক অভিনয়ের সমাপ্তি ঘটে ‘সবুজ সাথী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সবুজ সাথী চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নায়ক হিসেবেই অভিনয় চালিয়ে যান।

তার উল্লেখ্যযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে, রাজদুলারী,আসামী হাজির, তুফান, মহেশখালীর বাঁকে, নাগ নাগিনী, বিজয়িনী সোনাভান, সুন্দরী, প্রতিজ্ঞা, কসাই, নবাবজাদী, বাঁধনহারা, ওস্তাদ সাগরেদ, সবুজ সাথী এবং 
লাইলী মজনু, লালু মাস্তান।

সোহেল চৌধুরী: সোহেল চৌধুরী বাংলাদেশী আশি-নব্বই দশকের বাংলা সিনেমার সাড়া জাগানো জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ও বিজনেসম্যান। ১৯৮৬ সালে সোহেল চৌধুরীর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র মুক্তি পায় । ১৯৮৪ সালের নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন । তিনি সেই বছরেই নির্মাতা এফ কবির চৌধুরী পরিচালিত পর্বত চলচ্চিত্তের মাধ্যমে অভিষেক হয়।

তিনি ৩০ টির ও বেশি চলচ্চিত্তে অভিনয় করেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্তে যে কজন সুদর্শন অভিনেতা আছেন সোহেল চৌধুরীর তাদের মধ্যে একজন বলে বিবেচনা করা হয়। সোহেল চৌধুরী কয়েকটি ছবিতে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেন। কয়েকটি ছবিতে তিনি সহ-অভিনেতার ভুমিকায় ছিলেন।

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেলকে গুলি করে হত্যা করা হয় ।

জাফর ইকবাল: আশির দশকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন জাফর ইকবাল। তিনি একাধারে অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ও একজন মুক্তিযোদ্ধা। চিরসবুজ নায়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন জাফর ইকবাল। শহুরে রোমান্টিক ও রাগী তরুণের ভূমিকায় দারুণ মানালেও সব ধরনের চরিত্রে ছিল তার স্বাচ্ছদ্য বিচরণ। অভিনয়ের পাশাপাশি চমৎকার গান গাইতে পারা এ অভিনেতা বেশকিছু সিনেমায় গায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। 

১৯৮৪ সালে আনোয়ার পারভেজের সুরে রাজ্জাক অভিনীত বদনাম সিনেমার 'হয় যদি বদনাম হোক আরও’ তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। মূলত তিনি ছিলেন গিটারবাদক। ভালো গিটার বাজাতেন বলে সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে অনেক সিনেমার আবহসংগীত তৈরি করিয়েছেন। তার সেই সিনেমাগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে জাফর ইকবাল চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। তার অভিনীত প্রথম ছবির নাম আপন পর। এই ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন কবরী। জাফর ইকবালের সাথে অভিনেত্রী ববিতা জুটি হয়ে প্রায় ৩০টির মত ছবি করেন। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় ১৫০টি সিনেমা করেন। 

জাফর ইকবাল অভিনীত ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’ ,‘সন্ধি’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র সুপারহিট হয়।

পারিবারিক অশান্তির কারণে জাফর ইকবাল মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। পরবর্তীকালে মদ্য পানসহ অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের ফলে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তার হার্ট এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। 

সালমান শাহ: "তিনি আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন!" কিছু মানুষ এমনই হয় সম্ভবত। এভাবে তাঁরা আসেন এবং জয় করে নেন। এমনই একজন, বাংলা চলচ্চিত্রের যুবরাজ অমর নায়ক সালমান শাহ। খুব রাজসিকভাবে তাঁর আগমন হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রে। নিজের স্বভাব সুলভ চাহনি, সুদক্ষ অভিনয় আর আধুনিকতায় নিজেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই  সুপরিচিত করে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ এবং ১৯৯৭ সালে ‘বুকের ভিতর আগুন’ ৪ বছরে ক্যারিয়ারে ২৭টি সিনেমা উপহার দেন তিনি। কিন্তু সব ছেড়ে হঠাৎ করেই অতৃপ্ত বাসনায় অদেখা ভুবনে পাড়ি জমান এই অমর নায়ক।

স্বপ্নের ঠিকানা, অন্তরে অন্তরে, বিক্ষোভ, সত্যের মৃত্যু নেই, তোমাকে চাই, মায়ের অধিকার, স্বপ্নের পৃথিবী, আনন্দ অশ্রুর মতো ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন। যার বেশিরভাগ সিনেমাই জনপ্রিয় হয়েছিল, কালের প্রবাহে সিনেমারগুলোর চাহিদা যেন বেড়েই চলেছে দর্শকদের কাছে।

তবে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার মধ্যে দিয়ে সিনেমা জগতে তার অভিষেক ঘটলেও ,মূলত আশির দশকে হানিফ সংকেতের ‘কথার কথা’ নামে একটা অনুষ্ঠানে মিউজিক ভিডিওর মডেল হিসেবে মিডিয়াতে তার যাত্রা শুরু হয়। এছাড়া কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে না থাকলেও সালমান শাহ’র অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল বিটিভ’তে প্রচারিত ‘পাথর সময়’ নাটকের মাধ্যমে। 

কিন্তু সব ছেড়ে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।  রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে তাঁর নিজ বাস ভবনে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। ময়না তদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য এখনো কাটেনি।

সালমান শাহ এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে সেদিনই সারা বাংলাদেশে প্রায় ২১ জন মেয়ে আত্মহত্যা করেন। আজ নেই সালমান শাহ। কিন্তু  প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দর্শকদের অন্তরে অন্তরে রয়ে গেছেন তিনি। 

মান্না: আম্মাজানের রগচটা ছেলে হোক কিংবা ন্যায় নিষ্টাবান পুলিশ অফিসার যে কোনো বেশে, যে কোনো চরিত্রে পর্দায় তিনিই সেরা ছিলেন। তার প্রতিটি চরিত্রই মুগ্ধ করেছে দর্শকদের। তাই তো মান্নাকে হারানোর ১৩ বছর পরও দর্শক হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে মান্নার নাম।

২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয় নায়ক। এমনকি মৃত্যুর আগেও রাতেও শুটিং করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্ম গ্রহন করেন। তার আসল নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার। ব্যক্তিগত জীবনে মান্না তার কর্মজীবনের শুরুর দিকের সহ-অভিনেত্রী শেলী কাদেরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির সিয়াম ইলতিমাস মান্না নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (এফডিসি) আয়োজিত নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৫ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত পাগলী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। যদিও তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তওবা। 

তবে ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত কাসেম মালার প্রেম চলচ্চিত্রে প্রথম একক নায়ক হিসেবে চম্পার বিপরীতে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হলে, তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করারও সুযোগ পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। 

একের পর এক সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। এরপর থেকে একচেটিয়া অভিনয় করে গিয়েছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন তার সহ অভিনেত্রী হিসেবে পুর্নিমাই ছিল তার প্রথম পছন্দ। 

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে- সিপাহী, যন্ত্রণা, অমর, পাগলী, ত্রাস, লাল বাদশা, আম্মাজান, আব্বাজান, রুটি, অন্ধ আইন, স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ, অবুঝ শিশু, মায়ের মর্যাদা, মা-বাবার স্বপ্ন, হৃদয় থেকে পাওয়া ইত্যাদি।

আমারসংবাদ/এডি