প্রিন্ট সংস্করণ
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৮, ০৮:৩২ পিএম
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা নিদর্শন নিয়ে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর। জাদুঘরে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও মহান ব্যক্তিদের নানা নিদর্শন, আছে টাকার গাছ, ঐতিহাসিক কামান, শিল্পকর্মসহ অনেক কিছু। এই জাদুঘর নিয়ে লিখেছেন-জিয়া উল ইসলাম
ভাষা আন্দোলন জাদুঘর
বহু প্রাণ আর বহু ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের বাংলা ভাষা। রাজপথে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরো অনেকে। তাঁদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার তাগিদ থেকেই গড়ে তোলা হয় ‘বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলায় ২০১০ সালে এ জাদুঘর গড়ে তোলা হয়। জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলার চারটি কক্ষের পুরোটাই ভাষা আন্দোলনের নানা স্মৃতি ও সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে। কক্ষগুলোয় ভাষাশহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সার্টিফিকেট, ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহৃত কোট, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্মারকলিপি, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থের পৃষ্ঠা ও ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের প্রিয় চটের ব্যাগটিও এখানে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলি সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ, সে সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ও বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। ভাষার মাসে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর খোলা থাকে। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা নিদর্শন জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। প্রাচীন যুগ থেকে আজকের বাংলাদেশ যতগুলো সিড়ি পার করেছে তার সবকটির চিহ্ন ধরে রেখেছে জাতীয় জাদুঘর। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে পরিচয় করিডে দেওয়া এবং তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে ঢাকা জাদুঘর নামে আত্মপ্রকাশ করে আজকের জাতীয় জাদুঘর। ১৯১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে এর উদ্বোধন করেন তদানিন্তন বাংলার গভর্নর লর্ড কার মাইকেল। ১৯৭০ পাকিস্তান সরকার ঢাকা জাদুঘর কমিটির পরিবর্তে ঢাকা জাদুঘর প্রযতœ বোর্ড অধ্যাদেশ জারি করে একে সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় রূপ দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৩ সালে ঢাকা জাদুঘরকে বাংলাদেশ জাতীয জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। রাজধানী ঢাকার শাহাবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে এর অবস্থান।ভবনের যেখানে যা দেখতে পাবেন : জাদুঘর প্রাঙ্গণটি নানান রকম গাছে সুসজ্জিত। ভবনের প্রবেশ দ্বারের দু’পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক দুটি কামান। ৪ তলা বিশিষ্ট ভবনটির ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নান্দনিক নভেরা ভাস্কর্য। এই ভবনের প্রথম তলায় অফিস, হল রুম ও অন্যান্য। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ তলায় ঐতিহাসিক সকল নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে যা প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত। দ্বিতীয় তলায় গেলে দর্শনার্থীরা সামগ্রিক বাংলাদেশ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র, গাছপালা, জীবজন্তু, উপজাতি জনজীবন, শিলা, খনিজ, সুন্দরবন ও অতীত সময়ের বিভিন্ন মুদ্রা ও স্থাপত্য। তৃতীয় তলায় সজ্জিত আছে-অস্ত্রশস্ত্র, চীনামাটির শিল্পকর্ম, পুতুল ও বাদ্যযন্ত্র, বস্ত্র ও পোশাক-পরিচ্ছদ, নকশী কাঁথা, পান্ডুলিপি, সমকালীন শিল্প ও আবহমান বাংলাদেশ। বিশ্বসভ্যতা ও শিল্পকলা সম্পর্কে ধারণা পাবেন। চতুর্থ তলায় সজ্জিত আছে, বিশ্ব মনীষীদের প্রতিকৃতি, বিশ্ব শিল্পকলা, বিশ্ব সভ্যতা প্রভৃতি।এছাড়্ওা প্রাকৃতিক ইতিহাস, জাতিসত্তা ও শিল্প, ইতিহাস ও ধ্রুপদী এবং সমকালীন শিল্পকর্ম ও বিশ্ব সভ্যতা এই চারটি বিভাগে বিভক্ত সংগ্রহশালার গ্যালারি।জাদুঘরে অতি মূল্যবান কিছু নিদর্শন রয়েছে যা কখনও পুনরায় সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এসকল নিদর্শনগুলো খুব সতর্কতার সাথে স্টোরে সংরক্ষিত রয়েছে যার সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রহরী। বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহের অন্যসব দিন এই সংগ্রহশালা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি ও জাতীয় দিবসগুলোতে এখানে বেশী ভিড় হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল, শীতকাল ও রমজান মাস পরিদর্শনের সময়সূচি এই তিনটি ভাগে বিভক্ত।গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল- সেপ্টেম্বর) শনিবার-বুধ (সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে)শীতালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) শনিবার-বুধ (সকাল ৯.৩০ টা থেকে বিকাল ৪.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে)কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। কাউন্টার প্রধান গেইটের পাশে অবস্থিত।টিকেট মূল্য ৩ -১২ বছর পর্যন্ত ৫ টাকা : ১২ বছর এর উপরে ১০ টাকাবিদেশী দর্শনার্থী ৭৫ টাকা।
টাকা জাদুঘর
বাংলাদেশ ও বিশ্বের মদ্রা ইতিহাস সংরক্ষণ, মুদ্রার ঐতিহ্য ও বিকাশকে সাধারণের মাঝে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ৫ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম ‘টাকা জাদুঘর’। রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তলায় ‘টাকা জাদুঘর’ স্থাপিত।টাকা জাদুঘরে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩ হাজার পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহ করা হয়েছে। পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। টাকা জাদুঘরে দুটি গ্যালারি। গ্যালারি-১ এ উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসনামলে প্রচলিত মুদ্রা প্রদর্শিত করা হয়। আর গ্যালারি-২ তে প্রদর্শিত হচ্ছে বর্তমান সময়ের সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, স্পেন, আর্জেন্টিনা, নিউজিল্যান্ড, নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশের মুদ্রা। মুদ্রার পাশাপাশি এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীন মুদ্রা দ্বারা নির্মিত অলঙ্কার, মুদ্রা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কাঠের বাক্স, লোহার তৈরি কয়েন ব্যাংক, লোহার সিন্ধুক প্রভৃতি। এ ছাড়া, শস্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত মাটির মটকাও প্রদর্শিত হচ্ছে এই জাদুঘরে। বশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কাগজের নোটসহ এ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সাবেক চেকোসেøকিয়া দ্বতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জাপানি ডলার, ইতালি, সাবেক বিভক্ত জার্মানি, আফগানিস্তান, চীন, ল্যাটিন আমেরিকা, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ভিয়েতনাম এবং কমিউনিস্ট আমলের পোল্যান্ডের নোট। এছাড়া রয়েছে ভারত, পাকিস্থান এবং বাংলাদেশের কাগজের নোট। আছে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, দিবস এবং কালজয়ী ব্যক্তিদের স্মরণে এ পর্যন্ত ১১টি স্মারক মুদ্রা এবং ৩টি স্মারক নোট মুদ্রিত হয়েছে। এগুলো টাকা জাদুঘরে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে।
টাকা গাছ ও রেপ্লিকা : জাদুঘরের সৌন্দর্যকে পূর্ণ মাত্রা দিতে প্রবেশপথের দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে টাকা গাছ। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে প্রাচীন বাংলায় প্রচলিত মুদ্রা থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত মুদ্রা ও টাকার রেপ্লিকা।
দেয়ালে চিত্রিত টেরাকোটার কাজ জাদুঘরের শ্রী বৃদ্ধিতে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। পোড়ামাটির তৈরি এ ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত লেনদেনের ধারাবাহিক চিত্র।
‘কয়েন ক্যাফে’ : প্রায় সাড়ে চার হাজার মুদ্রা ও নোট দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বিশ্রাম আর অল্পস্বল্প খাওয়াদাওয়ার জন্য চালু হয়েছে ‘কয়েন ক্যাফে’। ব্যস্ত জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে ইতিহাসের সঙ্গী হতে চাইলে ঢাকা জাদুঘর যে অনন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘টাকা জাদুঘর’ পরিদর্শনের সময়সূচি : বেলা ১১টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত জাদুঘরটি খোলা থাকে। শুক্রবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। ‘টাকা জাদুঘর’ এর কোন প্রবেশ মূল্য নেই।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাসের গৌরবময় সাহসী এক অধ্যায় এদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের পর ১৭৫৭ -১৯৭১ দীর্ঘ এই দুই শতকে বহু বীর বহুবার স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে, লড়াই করেছে, শহীদ হয়েছে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ জাতি বিজয় ছিনিয়ে আনে, পূরণ হয় দুই শতকের স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই সব সংগ্রামের সাহসী কাহিনী তথ্য চিত্র, আলোকচিত্র এবং ইতিহাসের নানান স্বারকের সমন্বয়ে গড়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আটজন ট্রাস্ট্রি উদ্যোগে ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুন বাগিচার একটি সাবেকী ভবনে এর দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। এই জাদুঘর জাতির গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সম্পৃক্তির মাধ্যমে বিকশিত সমাজ গঠনে প্রেরণা সঞ্চারে সচেষ্ট রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিচালিত হয়। শিল্পকলা একাডেমি থেকে দুই-তিন মিনিটের পায়ে হাঁটার দূরত্বে এটি ৫, সেগুন বাগিচা, ঢাকা অবস্থিত। জাদুঘর ভবনটি ৩ (তিন) তলা। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় প্রদর্শনী চলে। জাদুঘরের প্রবেশের পথে হাতের ডান পাশে রয়েছে একতলা একটি ভবন যেখানে রয়েছে একটি অডিটোরিয়াম, অফিস এবং একটি বিক্রয় কেন্দ্র যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বই ও স্মারক বিক্রি করা হয়। এছাড়া জাদুঘর ভবনের পেছনে রয়েছে আউটরিচ কক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে রয়েছে একটি প্রাঙ্গণ যাকে ক্যাফে থিয়েটার বলা হয়। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে রয়েছে ছনের তৈরি চারটি ছাতা এবং প্রতি ছাতার নিচে রয়েছে তিনটি করে চেয়ার। এখানে বসে দর্শনার্থীরা বিভিন্ন জল খাবার খেতে পারেন।জাদুঘর ভবনের প্রবেশ মুখের ছোট প্রাঙ্গণে রয়েছে শহীদ ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি ব্যবহৃত একটি গাড়ি (ঢাকা-গ ৩২২০) এবং ভবনের সামনে শিখা চির অম্লান যেখানে লেখা আছে-
“সাক্ষী বাংলার রক্ত ভেজা মাটি
সাক্ষী আকাশের চন্দ্র তারা
ভুলি নাই শহীদের কোন স্মৃতি
ভুলবো না কিছুই আমরা”
জাদুঘর ভবনের নিচতলার প্রথম কক্ষ এখানে ২টি গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারি-১: “বাংলার সর্ব ধর্মমত সহিষ্ণু সমাজ ও উদার নৈতিক সংস্কৃতি” প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য ও জনপদ সম্পর্কে ধারণা দিতে এখানে প্রদর্শিত হয়েছে-ষাটগম্বুজ মসজিদ, নবরতœকান্তনগর মন্দির, অতিশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের চোট কাঁচে ঘেরা রেপ্লিকা, তালপাতার পুথি, প্রাচীন গীর্জা, প্রাচীন বাংলার শিল্প কর্মের নিদর্শন এর কিছু ছবি। গ্যালারি-২
ব্রিটিশ শাসন আমল : স্থানীয় ও জাতীয় সংগ্রাম, ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি ও সংগ্রামের চিত্র ফুটে উঠেছে এই গ্যালারিতে। এখানে সংরক্ষিত আছে পলাশী যুদ্ধে উভয় পক্ষের সেনাদলের অবস্থানের নকশা, অসহযোগ ও স্বদেশি আন্দোলনের সময় চরকায় কাঁটা সুতি শাড়ি এবং বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলনের সময়কার কাঁটা সুতি শাড়ি এবং ঢাকার বিখ্যাত মসলিন শাড়ি।
জাদুঘর ভবনের নিচতলার ২য় কক্ষ : এখানে রয়েছে পাকিস্তান জন্ম ইতিহাসের ছবি এবং প্রাগৌতিহাসিক যুগের নিদর্শন।
নিচতলার ছোট ৩য় কক্ষ : বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যেসব বীর বাঙ্গালী ফাঁসি কাষ্ঠে জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই সব বীরদের একটি তালিকা রয়েছে এই কক্ষে। এই তালিকায় ক্ষুদিরাম বসুসহ মোট ২৯ জনের নাম রয়েছে। নিচতলার ৪র্থ কক্ষ : (১৯৪৮- ৫২) ৬৮, ৬৯ এবং ৭০- এ ঘটে যাওয়া আন্দোলন ও কর্মসূচির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এই কক্ষে। এই ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-গণ আন্দোলনে নারী সমাজ, ভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগের ভরাডুবি ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের ছবি। এছাড়াও রয়েছে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়কার ছবি এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁনের ক্ষমতা গ্রহণ ও সাধারণ নির্বাচনের ছবি। নিচতলার চতুর্থ কক্ষে থেকে পরবর্তী কক্ষে যাওয়ার পথে বারান্দায় রয়েছে একটি টাচ স্ক্রীন মনিটর যেখানে নির্দেশাবলী মেনে স্পর্শ করলে খুব সহজেই ইতিহাসের ছবি ও ভিডিও দেখা যাবে।
নিচতলার ৫ম কক্ষ : একাত্তরে উত্তাল বাংলার গর্জে ওঠা ও ২৫শে মার্চ এর গণহত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে এই কক্ষে সংরক্ষিত ছবিগুলোতে। এখানে দেখতে পাবেন একাত্তরের শরনার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন চিত্র।
অসহযোগ আন্দোলন, ঢাকায় ভয়াবহ গণহত্যা (১৯৭১, ২৫ মার্চ), ইয়াহিয়া, ভূট্টোর প্রতারণামূলক আলোচনা, সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ছবি ও লিখিত বর্ণনা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুজিবনগর মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণের ছবি ও লিখিত বর্ণনা। এছাড়া আরো দেখেত পাবেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু যন্ত্রাংশ।
পরিদর্শনের সময়সূচি : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনের সময়সূচি গ্রীষ্মকাল ও শীতকাল এই দুই ভাগে নির্ধারণ করেছেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
গ্রীষ্মকাল : সোমবার থেকে শনিবার, সকাল ১০.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
শীতকাল : সোমবার থেকে শনিবার, সকাল ১০.০০ টা থেকে বিকাল ৫.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে।
জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য দর্শনার্থীরা সাধারণত শুক্রবার ও শনিবার বেশী ভিড় করে। এছাড়া ১লা বৈশাখ, ২৬ শে মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৭ই মার্চ, ১৫ই আগষ্ট এসব দিনগুলোতে ভিড় হয়। সাধারণত সকল শ্রেণীর লোকজন জাদুঘর পরিদর্শনে আসে।
টিকেট সংক্রান্ত তথ্য : জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। প্রধান গেইটের বাম পাশে জাদুঘরের কাউন্টারটি অবস্থিত। টিকেট মূল্য ৫ (পাঁচ) টাকা। তবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা বিনামূল্যে জাদুঘরে প্রবেশ করতে পারবে। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র কাউন্টারে জমা রাখতে হয়।
সামরিক জাদুঘর
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য এবং মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডি বিশ্বে বিভিন্ন মিশনের সফলতা সহ বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্রের সংগ্রহ নিয়ে সারক জাদুঘরটি সজ্জিত। ১৯৮৭ সালে ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারে প্রথম সামরিক জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় । জাদুঘরের গুরুত্ব এবং দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ১৯৯৯ সালে জাদুঘরটি স্থায়ীভাবে ঢাকার বিজয় সরণিতে স্থানান্তর করা হয। সামরিক জাদুঘরের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে ট্যাংক পিটি-৭৬। রাশিয়ার তৈরি এই ট্যাংকটি পানিতেও ভেসে চলতে সক্ষম। এই ট্যাংকটি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে বাংলাদেশ বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তান দখলদার-বাহিনীর নিকট হতে উদ্ধার করা হয়। সামরিক জাদুঘরের মাঠের উত্তর ও পূর্ব দিক দিয়ে সুসজ্জিত ভাবে আরও ১৬টি ট্যাংক ও কামান প্রদর্শিত হচ্ছে।
মুজিব কর্নার : সামরিক জাদুঘরের নীচ তলায় পশ্চিম পাশের কক্ষে একাংশে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে মুজিব কর্নার। এখানে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ৩০টি আলোকচিত্র অঙ্কিত আছে।
স্টাফ কার : জাদুঘরের আরেক আকর্ষণ হলো পাক সেনাবাহিনী থেকে উদ্ধারকৃত স্টাফ কার মার্সিডিজ বেঞ্জ ও সিলিন্ডার ২০০০ সি সি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট লে. জে. জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এটি ব্যবহার করতেন।
টিকেট ও সময়সূচি : এই জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কোন টিকেট লাগে না। সপ্তাহের পাঁচ দিন শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার জাদুঘর খোলা থাকে। গ্রীষ্মকালে সকাল ১০.৩০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালে ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বুধবার এবং শুক্রবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মৃতি জাদুঘর
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের যে বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, স্বাধিকারের সংগ্রামে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, সে বাড়িটি আজ তাঁর নানা স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। বর্তমানে এটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘর ভবনটিতে ঢুকে এক তলাতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। একতলায় জাদুঘরটির প্রথম কক্ষে ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে বলা যায়। সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের আলোকচিত্র রয়েছে এখানে। এই কক্ষটি ছিল ড্রইং রুম। যেখানে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে বৈঠক করেছেন। এই কক্ষের পাশের কক্ষটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে বসে তিনি লেখালেখিও করতেন। এখান থেকেই তিনি ৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় এখনো চোখে পড়বে সেই রাতের তান্ডবলীলার নিদর্শন। এছাড়া এখানে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি রয়েছে। দোতলায় গিয়ে প্রথমেই যে কক্ষটি পাওয়া যায় সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসকক্ষ। এর পরের প্রথমে কক্ষটি ছিল তাঁর শোবার ঘর, তারপরের কক্ষটি কক্ষটি শেখ রেহানার শোবার ঘর। এ কক্ষগুলোয় এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারবর্গের নানা স্মৃতি চিহ্ন। এটি কেবল একটি পারিবারের স্মৃতি চিহ্ন নয়। এগুলো একটি জাতির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এখানে থাকা বিভিন্ন প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস। যেমন- বল, হিকষ্টিক, ব্যাট, হেলমেট, সুলতানা কামালের সঙ্গে তার ছবি ইত্যাদি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তো রয়েছেই। আরও নিদর্শন প্রদর্শনীর জন্য আনার কথা রয়েছে।
সময়সূচি : বুধবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘরটি। এটিতে সাধারণত শুক্রবার ও শনিবার ভিড় বেশি হয়।
টিকেট : এই জাদুঘরটির একটি মাত্র টিকেট কাউন্টার রয়েছে। ভিড় থাকলে লাইন ধরে টিকেট কাটতে হয়। টিকেটের মূল্য ৫ টাকা। ৩ বছরের কম বয়সীদের কোন টিকেটের প্রয়োজন হয় না। আর শুধুমাত্র শুক্রবার ১২ বছরের কম বয়সীরা টিকেট ছাড়া প্রবেশের সুযোগ পায়।