Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

নানা সংকটে জর্জরিত ‘দূর দ্বীপবাসী’

জিয়াবুল হক, টেকনাফ

নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০৬:৩৫ এএম


নানা সংকটে জর্জরিত ‘দূর দ্বীপবাসী’

দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ কক্সবাজার টেকনাফের সেন্টমার্টিন। দ্বীপটি 'নারকেল জিঞ্জিরা' নামে খ্যাত। প্রতিবছর এই দ্বীপে দেশ-বিদেশে থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। প্রবাল পাথুরে সৈকত, চোখ জুড়ানো নারিকেল বীথি, কেয়াবন, নীল জল দিগন্তসহ হরেক রকম নৈসর্গিক দৃশ্য একইসঙ্গে দেখা যায় এই প্রবাল দ্বীপে। এর সঙ্গে আছে মানববসতিহীন ছেঁড়া দ্বীপ। তারপরও যেন মানুষের কোনও অভাব নেই। পর্যটন মৌসুমে প্রায় প্রতিনিদিই শত শত মানুষ যায় এ দ্বীপে। পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনার এ দ্বীপে পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখানকার স্থানীয় জনসাধারণ নানান সংকটে জর্জরিত।

সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীরা কেমন আছেন বা কেমন থাকেন, সর্বোপরি তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা কেমন তার খোঁজ হয়তো দু'দিনের অতিথিরা রাখেন না। তেমনি ৯ হাজার মানুষের দ্বীপটির খোঁজ রাখেন না সরকার বা প্রশাসন-এমনই অভিযোগ এই দ্বীপবাসীর।

অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় 'পেটোয়া' শ্রেণির লোকজনের দৌরাত্ম্য ও দ্বীপবাসীর জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দিনে দিনে এর চিত্র আরও ভয়াবহ হচ্ছে। মানবসৃষ্ট সমস্যা ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা: 
সেন্টমার্টিনবাসী অন্যতম প্রধান সমস্যা যোগাযোগ। টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে জাহাজে চড়ে দ্বীপে যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। আর কাঠের নৌকা হলে সেই সময় চার ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। ফলে যে কোনও জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।

স্পিড বোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তা চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হলো মোটা অংকের জাহাজ ভাড়া। তার সঙ্গে রয়েছে ঘাটে ব্যাপক হারের চাঁদাবাজি।

কোনও পণ্য সেন্টমার্টিনে নিতে গেলে কেনা মূল্যের কাছাকাছি টোল দিতে হয় বলে অনেকের অভিযোগ। এ নিয়ে সাধারণ লোকজনের 'কিছু বলার' সুযোগ নেই। আর বললে ঘাট ওয়ালাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে দিগুণ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় দ্বীপবাসীকে।

[media type="image" fid="98864" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

হাসপাতাল:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রকট সংকট। কারণ যোগাযোগ ও চিকিৎসা সংকট একই সূত্রে গাঁথা। দ্বীপে একটি মাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। তাতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেখানে পা পড়েনি কোনও চিকিৎসকের। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে 'ছাগলের খোয়াড়' বলেন দ্বীপবাসীরা।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থা:
এবার আসা যাক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কথায়। সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য আকষর্ণীয় হলেও এখনও পর্যন্ত দ্বীপে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধুই পর্যটকদের জন্য। সৌর বিদ্যুতের দেখা মিললেও দরিদ্রতার কারণে অধিকাংশ মানুষ এর বাইরে। দ্বীপে এক সময় সরকারি উদ্যোগে একটি অস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও ১৮ বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে।

১৯৯৯ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেনারেটরটি বিকল হয়ে যায়। তারপর আর চালুর উদ্যোগ নেয়নি সরকার। আর বিদ্যুৎ না থাকায় আধুনিক প্রযুক্তি থেকেও বঞ্চিত এখানকার মানুষ। এমনকি মোবাইল চার্জ নিয়েও মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। জেনারেটরের মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দিতে গিয়ে নষ্ট হয় মোবাইল।

শিক্ষা ব্যবস্থা:
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও সেন্টমার্টিনবাসীর বেলায় তা হয়তো খাটে না। এখানকার লোকজন শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে। ৯ হাজার মানুষের এই দ্বীপে রয়েছে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাতেও রয়েছে শিক্ষক সংকট। এই বিদ্যালয়ে ৫০২ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র দু'জন শিক্ষক।

বেসরকারি ভাবে আরও দু'টি স্কুল থাকলেও তাতেও নানা সংকট। ফলে দ্বীপের অনেক শিশু এখন বিদ্যালয়ে যায় না।

সেন্টমার্টিনে রড, সিমেন্টসহ আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী নেওয়ার অনুমতি নেই। এতে করে অনেকে স্থাপনা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তবে প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এ নিয়মের বাধা নেই। সাধারণ লোকজন না পারলেও প্রভাবশালীরা ঠিকই রড-সিমেন্টের বাড়ি করছেন। একইভাবে বহুতল ভবনের নির্মাণের নিয়ম না থাকলেও প্রভাবশালীরা বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। স্থানীয়দের বাধা দিলেও প্রভাবশালীদের বাধা দেয় না পরিবেশ অধিদফতর- এমন অভিযোগ করেছেন দ্বীপবাসী।

[media type="image" fid="98864" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

সরকার দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে তথ্য-প্রযুক্তির সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু সেন্টমার্টিনের চিত্র ভিন্ন। সেখানে তথ্য সেবা কেন্দ্র নেই তা নয়, তা রয়েছে কাগজে-কলমে। সামান্য দু'টাকার ফটোকপি জেনারেটরের সাহায্যে করাতে কখনও কখনও ৫০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। একইসঙ্গে জন্মনিবন্ধনসহ নানা সমস্যা পড়ছেন এখানকার মানুষ। স্থানীয় চেয়ারম্যান নুর আহম্মদকে বারবার বলা হলেও তা কাজ হয়নি।

ব্যাংকিং সুবিধার হয়তো দ্বীপের অনেকের কাছে অজানা। সেন্টমার্টিনে কোনও ব্যাংকের শাখা নেই। এ কারণে অনেকে চাইলেও ব্যবসা করতে পারছেন না। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সেন্টমার্টিন অবহেলিত থাকলেও কোনও সরকারই তাদের উন্নয়নে এগিয়ে আসেনি। স্থানীয় চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা প্রশাসন, এমনকি কোনও সংসদ সদস্যই সেন্টমার্টিন নিয়ে ভাবেননি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে সদা সংকিত দ্বীপবাসী। সাগরে পানি বাড়লেই তা ধেয়ে আসে লোকালয়ে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া বছরের পুরো সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে থাকে দ্বীপের লোকজন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে দ্বীপটি ক্রমান্বয়ে ভেঙে যাচ্ছে। তা রোধে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা হয়নি।

দ্বীপবাসীর সমস্যার আরেক নাম তাদের সেবায় নিয়োজিত কোস্টগার্ডও। কোস্টগার্ড তল্লাশির নামে করে হয়রানি। সেই সঙ্গে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। একইভাবে জেলেদেরকেও হয়রানি করছে তারা।

সেন্টমার্টিন আদর্শ সংসদের সভাপতি হেলাল উদ্দীন সাগর বলেন, সেন্টমার্টিন আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট। কিন্তু সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের সে রকম কোনও পরিকল্পনা নেই। অথচ অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আমি সরকার দলীয় হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়নের তেমন কিছু করা হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপার টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের অনেক সমস্যা আছে। ঘাটে হয়রানি, নৌযান সমস্যা, দ্বীপের নিরাপত্তা। কিন্তু পরিবেশ সংকটাপন্ন হবে বিধায় অনেক কিছু করার থাকলেও করা যাচ্ছে না। আমি এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানাবো।

টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, সেন্টমার্টিনে অনেক সমস্যা রয়েছে সেটা আমি জানি। আমরা চেষ্টা করছি সেসব সমস্যাগুলো নিরসন করতে। পর্যায়ক্রমে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।

আমারসংবাদ/কেএস