Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

এলএসডি সেবনে মস্তিষ্কে কী ঘটে!

আমার সংবাদ ডেস্ক

মে ৩১, ২০২১, ০৭:২০ এএম


এলএসডি সেবনে মস্তিষ্কে কী ঘটে!

এল এস ডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড নামটি আগে না শুনলেও, বর্তমানে আলোচনার শীর্ষে এখন এই নামটি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তে উঠে আসে এই ভয়াবহ মাদকের নাম। 

নিজের গলায় দা চালিয়ে আত্মহত্যা করা হাফিজুর এই মাদকেই আসক্ত ছিলেন। এই মাদক গ্রহণ করার পরই আত্মহত্যা করে হাফিজুর।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১৫মে রাত পৌনে ৮টার দিকে ঢামেকের সামনে এক ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটেন হাফিজুর। তখন উন্মাদের মতো হাফির বারবার বলছিলেন, আমাকে মাফ করে দাও। নিজের গলা নিজে কাটার কারণে হাফিজুর সেখানেই মারা যান।

এরপর পুলিশ অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর কারণ খুঁজতে নেমে ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য, উঠে আসে ভয়ংকর এলএসডির নাম। 

জানা গেছে, বিদেশ থেকে এই মাদক দেশে আনা হচ্ছে। অনেক ব্যয়বহুল এই মাদক উচ্চবিত্তদের মাঝে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। এলএসডি মাদক অনেক পুরোনো হলেও বর্তমানে এর ব্যবহার বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এই এলএসডি আসলে কী, এলএসডি সেবনের পর মস্তিষ্কে কী ঘটে কিংবা এর ক্ষতিকর দিকগুলোই বা কী কী এই মুহুর্তে তা জেনে রাখা ভীষণ জরুরি।

প্রথমেই জেনে নেই এলএসডি আসলে কী?

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ যা রাই এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরণের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়।

এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়।

এলএসডি'কে 'সাইকাডেলিক' মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরণের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশেপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো 'হ্যালুসিনেট' বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষও করে থাকে।

কিন্তু এই এলএসডি কীভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল? 

সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যানই প্রথম পরিচয় করে দেন এলএসডির সঙ্গে। তিনি মোটেও মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য এটি আবিষ্কার করেননি। ত্রিশের দশকে এরগট নামক এক ধরণের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের কার্যকরী ওষুধ হিসেবে এলএসডি আবিষ্কার করেন হফম্যান।

আসলে তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতার উন্নতি শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ তৈরির জন্য লাইসার্জিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করছিলেন হফম্যান। তখন হঠাৎ করেই নিজের অজান্তে এলএসডি নামক আধুনিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়াবহ ড্রাগের প্রভাব আবিষ্কার করেন হফম্যান।

১৯৩৮ সালে হফম্যান এই মাদক আবিষ্কারের পর এটি বিজ্ঞানী এবং ফিজিশিয়ানদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর, হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপরই তিনি চলে যান স্বপ্নের জগতে।

এর পরেরদিন হফম্যান তার জিভে নিলেন ২৫০ মাইক্রোগ্রাম এর প্রায় দশগুণ বেশি। ফলাফল একই ছিল, তবে ঘাবড়ে যান হফম্যান। দ্রুত চিকিৎসককে ডেকে নিজের ব্লাডপ্রেশার, হার্টরেট, শ্বাস-প্রশ্বাস সবই পরীক্ষা করান। সবেই ছিক ছিলো।

এরপর হফম্যান সহকর্মীরা সবাই স্বাদ, বর্ণ ও রংহীন সেই সাইকেডেলিক ড্রাগ একে একে টেস্ট করলেন। সবাই এটি ব্যবহারের পরপরই নতুন এক জগতের দেখা পেলেন। যা চিন্তা-ভাবনাকে মুহূর্তেই প্রভাবিত করতে পারে। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় ভয়াবহ মাদক এলএসডি।

এলএসডি সেবনের পর মস্তিষ্কে আসলে কী ঘটে?

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের গবেষণা অনুসারে, এই মাদকটি মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কার্যক্রম প্রভাবিত করে। এ কারণে মাদক ব্যবহারকারীর ব্যবহার, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করে।

এলএসডি নেয়ার পর সাধারণত মানুষ ‘হ্যালুসিনেট’ করে বা এমন দৃশ্য দেখে যা বাস্তবে নেই। অনেক সময় অলীক দৃশ্য দেখার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে মানুষ। অনেকেই এই মাদক ব্যবহারের পর ভালো অনুভূতি বোধ করেন। আবার অনেকেই উন্মাদ হয়ে ভয়ঙ্কর কিছু পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়েই বিপদগ্রস্ত হয়ে থাকেন।

এলএসডি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা বেকলি ফাউন্ডেশন সম্প্রতি এলএসডির উপর গবেষণা করেছে। এই গবেষণার প্রধান গবেষক ডেভিড নাট এই গবেষণাকে পার্টিকেল ফিজিক্সে হিগস বোসনের আবিষ্কারের সমতুল্য বলে আখ্যা দিয়েছেন।

শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ২০ জন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়। দু’দিন তাদের ওপর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ও ট্যাবলেট আকারে ৭৫ মাইক্রোগ্রাম এলএসডি প্রয়োগ করা হয়। এরপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ ও মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তের চলাচল পরীক্ষা করা হয় ও ছবি তোলা হয়। এই মাদক গ্রহণ করার আগে ও পরে সেবনকারীর মস্তিষ্কের ছবি তুলে পার্থক্য বের করা হয়।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এলএসডি গ্রহণের পর সেবকারী চোখ বন্ধ করেও অলীক সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পায়। তখন সে বাস্তব এবং কল্পনার জগতের মধ্যে মিল খুঁজে পায় না। তারা এসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না। কল্পনাশক্তির সাহায্যে তারা এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পায়।

গবেষণা থেকে জানা যায়, এলএসডি গ্রহণের পর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। একইসঙ্গে এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যাবস্থা দূর্বল হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা জানান, এলএসডি ব্যবহারকারীরা যে কল্পনাজগত চোখের সামনে দেখতে পান, সেসব মস্তিষ্কে জমে থাকা তথ্যভাণ্ডার থেকে আসে। সেসব তথ্য সবসময় মস্তিষ্কের পেছন দিকে অবস্থিত ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স থেকে আসে না।

অর্থাৎ মানুষের দৃশ্যমান স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে না। এই মাদকের প্রভাবে মস্তিষ্কের কাজ করার ভিন্ন ভিন্ন অংশ মিলেমিশে যায়। মস্তিষ্কের ছবি থেকে আরও জানা গেছে, একই সঙ্গে এলএসডি সেবনে কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং পৃথকভাবে কাজ করতে থাকে। ফলে ব্যবহারকারী পৃথিবীতে শুধু নিজেকেই দেখতে পান এবং একক সম্পর্ক অনুভব করেন, যাকে বলা হয় ইগো ডিসোল্যুশন।

[media type="image" fid="126208" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

এই মাদকের ক্ষতিকর দিক গুলো কী কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এর সমীক্ষা অনুসারে, এলএসডি গ্রহণের ফলে মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, অতিরিক্ত ঘামসহ নানা ধরণের মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়।

এলএসডি গ্রহণ করে ভুল রাস্তা দেখে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া বা অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা ব্যক্তিরা এলএসডি গ্রহণের পর আরো বেশি বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারেন বলেও উঠে এসেছে অনেক গবেষণায়।

ইউরোপের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট রিসার্চগেইট'এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয় এলএসডি গ্রহণের পরবর্তী জটিলতায়।

১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এলএসডিসহ সব ধরণের সাইকাডেলিক ড্রাগ নিষিদ্ধ করে। এরপর ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ চিকিৎসা কাজে এলএসডি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এই বিষয়ে গবেষণায় ভাটা পড়ে। তবে এখনও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মনোচিকিৎসক ও রসায়নবিদরা বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদের মতো অসুস্থতার চিকিৎসায় এখনো এলএসডির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

(তথ্যসুত্র- বেকলি ফাউন্ডেশন/বিবিসি)

আমারসংবাদ/এডি