Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ভারতে করোনার টিকা সনদে নরেন্দ্র মোদির ছবি কেন?

আমার সংবাদ ডেস্ক

অক্টোবর ১৯, ২০২১, ০৩:২০ পিএম


ভারতে করোনার টিকা সনদে নরেন্দ্র মোদির ছবি কেন?

কোভিড-১৯ টিকা নেয়ার সার্টিফিকেটে যাতে নরেন্দ্র মোদীর ছবি না থাকে, অসন্তুষ্ট একজন নাগরিকের এই আবেদন নিয়ে আগামী সপ্তাহে শুনানি করতে যাচ্ছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার একটি আদালত।

পিটার এম নামের ওই নাগরিক নতুন একটি সার্টিফিকেট চান, যেখানে নরেন্দ্র মোদীর ছবি থাকবে না। তিনি বলছেন, এটা তার মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে।

বাষট্টি-বছর বয়সী পিটার এম একজন তথ্য অধিকার অ্যাকটিভিস্ট এবং ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির একজন সদস্য।

''আমার সার্টিফিকেটে তার ছবি দেয়ার মানে হলো তিনি নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার প্রবেশ করছেন। এটা অসাংবিধানিক এবং আমি সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, অতি সত্বর যেন তিনি এই ভুল, লজ্জাজনক কাজ বন্ধ করেন, '' নিজের বাড়ি কোত্তায়াম জেলা থেকে টেলিফোনে বিবিসিকে বলেছেন পিটার এম।

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু করা টিকার সনদে, টিকা নেয়া ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত তথ্যের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর একটি ছবি থাকে। তার সঙ্গে ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর দু'টি বার্তাও থাকে।

গত অগাস্ট মাসে জুনিয়র স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভারতী প্রাভিন পাওয়ার পার্লামেন্টে বলেছেন, 'বড় ধরনের জনস্বার্থে' ওই ছবি এবং উদ্ধৃতি সার্টিফিকেটে যোগ করা হয়েছে-যাতে টিকা নেয়ার পরেও মানুষজন কোভিড সংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনে চলেন।

কিন্তু পিটার এমের যুক্তি, যারা এর মধ্যেই টিকা নিয়েছেন, তারা এর উপকারিতা সম্পর্কে জানেন। ফলে তাদের কাছে এসব বার্তা দেয়ার অর্থ নেই।

''মোদী আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন এবং এটাও ভারতের প্রথম টিকার কর্মসূচি না। কিন্তু কোভিড-১৯ বিরোধী প্রচারণা এবং টিকার কর্মসূচিকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন সবকিছুর কৃতিত্ব একজন ব্যক্তির, যা প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রোপাগান্ডা অস্ত্র,'' বলছেন তিনি।

পিটার এম বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ এই কারণে যে, একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা নিতে তাতে অর্থ খরচ করতে হয়েছে। কারণ যেখানে বিনামূল্যে টিকা দেয়া হয়, সেসব সরকারি হাসপাতালে লম্বা লাইন লেগে ছিল।

''প্রতিটা টিকার জন্য আমি ৭৫০ রুপি করে দিয়েছি। তাহলে কেন আমার সার্টিফিকেটে মি. মোদীর ছবি থাকবে?'' প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

তার এসব অভিযোগের ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারকে জবাব দেয়ার জন্য দু'সপ্তাহ সময় দিয়েছে কেরালা হাইকোর্ট।

পিটার এমের এই পিটিশনের ব্যাপারে বিবিসি সংবাদদাতার কাছে নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টির দুইজন মুখপাত্রের কেউ কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকা নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করেছে রাজনৈতিক বিরোধীরাও। বিরোধী দলগুলো শাসিত কয়েকটি রাজ্যে টিকার সনদে নরেন্দ্র মোদীর ছবি সরিয়ে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেয়া হয়েছে।

কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধরা মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি টিকার কর্মসূচিকে ব্যক্তিগত প্রচারণায় ব্যবহার করছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও বলেছেন, তার (নরেন্দ্র মোদী) উচিত মৃত্যু সনদেও তার ছবি যুক্ত করে দেয়া।

''মনে করুন আমি আপনার সমর্থক নই ...আমি পছন্দ করছি না, কিন্তু আমাকে এটা বহন করতে হচ্ছে। কেন? মানুষের স্বাধীনতা কোথায়?'' ।

''কোভিড সার্টিফিকেটে আপনার ছবি বাধ্যতামূলক করেছেন। তাহলে এখন এটা মৃত্যু সনদেও লাগিয়ে দিন,'' বলেছেন মমতা ব্যানার্জী।

যেসব ভারতীয়কে বিদেশে যেতে হয়, এই ছবি তাদের জন্যও সমস্যা তৈরি করেছে। ভাইস নিউজ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদীকে যেসব দেশের অভিবাসন কর্মকর্তারা চেনেন না, তারা কোন কোন পর্যটকের কাছে এসব সনদ জাল বলে সন্দেহ করেছেন।

পিটার এমের উদ্বেগ, যদি কোন প্রশ্ন না তুলে এই ব্যাপারটি মেনে নেয়া হয়, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে স্কুল আর কলেজের সার্টিফিকেটেও নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেখা যাবে।

তার এই উদ্বেগের বড় কারণটি হলো, মি. মোদীর ছবি অনেক সময় এমন সময় জায়গায় চলে যায়, যেখানে আসলে থাকার কথা নয়। যেমন সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপত্তির পর অফিসিয়াল কোর্ট ইমেইল থেকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারি বিজ্ঞাপনসূচক ছবি বাদ দেয়া হয়।

ছবি তোলা এবং সেলফি তোলার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসার কথা সবার জানা। সামাজিক মাধ্যমে তার অনেক ফলোয়ার রয়েছে। দেশজুড়ে তার সমাবেশগুলোয় লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়ে থাকে।

তার সমর্থকরা বলেন, টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকার মধ্যে ভুল কিছু নেই, কারণ তিনি হচ্ছেন দেশের সবচেয়ে পরিচিত মুখ।

মোদীর শশ্রুমণ্ডিত চেহারা ভারতের শত শত বিল বোর্ড আর স্ট্রিট হোল্ডিং রয়েছে। সংবাদপত্রের পূর্ণ পাতা সরকারি বিজ্ঞাপনে তার হাসিমুখ দেখা যায়। সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতেও তার হাসিমুখের ছবি থাকে।

সমালোচকরা বলে থাকেন, ভারতে কখনোই আত্ম-প্রচারকারী নেতাদের কমতি ছিল না। অতীতে বিজেপি এই জন্য কংগ্রেস নেতাদের সমালোচনা করেছেন। কারণ গান্ধী-নেহরু পরিবারের নামে শত শত এয়ারপোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, পুরস্কার আর কল্যাণ কর্মসূচির নামকরণ করা হয়েছে।

উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, দলিত সম্প্রদায়ের আইকন, মায়াবতী নিজের স্ট্যাচু বানিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ব্যক্তি পূজা উৎসাহিত করার অভিযোগও উঠেছিল।

সস্তা খাবারের ক্যান্টিন, ওষুধের দোকান আর লবণের প্যাকেটে নিজের ছবি জুড়ে দিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জয়ারাম জয়াললিতা।

''কিন্তু মি. মোদী এই আত্ম-প্রেমের বিষয়টিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন,'' বলছেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক এবং মি. মোদীর জীবনীকার।

''তিনি আরএসএসের (হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ), যারা বলে যে, ব্যক্তির চেয়ে সংগঠন বড়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সংগঠনের চেয়ে তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন," তিনি বলছেন।

''আপনি যদি তার কথা লক্ষ্য করেন, তিনি কখনো বলেন না যে, আমাদের সরকার, সবসময় বলেন, আমার সরকার অথবা মোদীর সরকার। জনসম্মুখে যখন তিনি আসেন, তখন অনেক বেশি আই, আমার, নিজের ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি এমনকি নিজের নামে একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করেছেন।''

মি. মুখোপাধ্যায় বলছেন, মি. মোদী এই মহামারিকে নিজের প্রচারণার জন্য একটি বিশাল সুযোগ হিসাবে নিয়েছেন।

''যেহেতু কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার একমাত্র উপায় টিকা, টিকার সনদে নিজের ছবি যুক্ত করে তিনি জনগণের উদ্ধারকর্তা হিসাবে নিজেকে দেখাতে চান,'' বলছেন মি. মুখোপাধ্যায়।

''তিনি দেবতার মানবরূপ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে চান, যাতে জনগণের আস্থা আর বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, যা পরে তার জন্য ভোটে রূপ নেবে।''

ইমেজ গুরু দিলীপ চেরিয়ান বলছেন, টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি যুক্ত করার বিষয়টি '' দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যা আদর্শ, কিন্তু সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে তার উপযুক্ততার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। ''

''ভোট টানতে এসব সার্টিফিকেট অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে,'' তিনি বলছেন।

''পুরো বিষয়টির মধ্যে একটা নির্বাচনী উদ্দেশ্য রয়েছে- যত উপায় আছে, সব ব্যবহার করা- তা সেটা টিকার সনদ হোক অথবা সরকারি কর্মসূচি, যেন সবখানে একই বার্তা প্রচার করা হয়।''

চেরিয়ান বলছেন, ''চেহারার পরিচিতি' একটি বড় বিষয়, কারণ এখন দলের পরিচিতি ব্যক্তি পরিচিতির সঙ্গে মিলেমিশে গেছে।

''সেখানে তার ছবি থাকা মানে হচ্ছে স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছে একটি দামী ব্র্যান্ড হিসাবে নিজেকে তুলে ধরা,'' বলছেন দিলীপ চেরিয়ান।

পিটার এম বলছেন, তার টিকার সনদে মি. মোদীর ছবি থাকার এটাই হলো আসল সমস্যা।

''তিনি একজন রাজনৈতিক, যিনি একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, যিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ফলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় এটা তাতে বাড়তি সুবিধা দেবে। সুতরাং এটা অবশ্য। বন্ধ করতে হবে,'' তিনি বলছেন।

আমারসংবাদ/ইএফ (বিবিসি)