Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

দ্রুত ৫০০ শয্যায় উন্নীত করার চেষ্টা সামেক

কাজী নাসীরউদ্দীন, সাতক্ষীরা

অক্টোবর ১৬, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


 দ্রুত ৫০০ শয্যায় উন্নীত করার চেষ্টা সামেক

নান্দনিক সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ২০১৭ হালে নিজস্ব ভবনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ সাতক্ষীরা জেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিরলস দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন প্রিন্সিপাল ডা. এস জেড আতিক। 

তিনি চিকিৎসাসেবায় ব্যবহূত চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি চাহিদার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় থেকে গ্রহণ করেন যা বিশ্বমানের। যে কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাওয়ার যে প্রবণতা ছিলো বর্তমান সময়ে তা বহুলাংশে কমেছে।

যারা ইতোপূর্বে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে গেছেন তারা সেখান থেকে ফিরে এসে সামেকের চিকিৎসাসেবার মান ও বিশ্বমানের চিকিৎসাসামগ্রী দেখে বলেন, এখন আর আমাদের চিকিৎসাসেবা নিতে ভারতে যেতে হবে না। আগামীতে ভারতীয়রা হয়তো বা চিকিৎসা নিতে আসবে বাংলাদেশে।  চিকিৎসা ক্ষেত্রে সামেকে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়ার আগেই চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন বর্তমান সামেক প্রিন্সিপাল ডা. রহুল কুদ্দুস। তিনি তখনকার সময়ের ডাক্তারদের সাথে নিয়ে জটিল ও কঠিন অপারেশন করে হাজারো মানুষকে সুস্থ করে তোলেন। 

জটিল ও কঠিন অপারেশনের সময় তিনি শিক্ষানবিশ ছাত্রদের পাশে রেখে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়েছেন। চিকিৎসাসেবা গতিময় করে তুলতে তিনি সকল বিষয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি নিরলস শ্রম দিয়ে চলেছেন। বিরামহীন মানুষটি যেনো কোনো ক্লান্তি অনুভব করেন না। তিনি সকল সময়ে চেষ্টা করেন সামেকে চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি পাক যাতে দেশ-বিদেশের মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে নির্দ্বিধায় সামেকে আসে। তাতে সামেকের সুনাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে।তিনি সামেকে শিক্ষানবিস ছাত্রদের সুচিসিৎসক হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগীদের সাথে নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। 

জানতে চাওয়া হয় সামেকে জটিল ও কঠিন রোগের অপারেশনের জন্য যে যন্ত্রপাতি আছে তা যথেষ্ট কি-না। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামেক ৫০০ বেডে উন্নীত করতে হলে সেখানে ২২টি অপারেশন থিয়েটার আছে সেগুলো চালু করতে হলে প্রথমেই যেগুলো অত্যন্ত জরুরি— প্রথমে অপারেশন টেবিল, অপারেশন লাইট, ছেকার মেশিন, বায়াথার্মি মেশিনসহ আরও অনেকগুলো যন্ত্রপাতি— যেগুলো ছাড়া ৫০০ বেডে উন্নীত করলে সেখান থেকে কোনো সুফল আশা করা যাবে না। 

প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যদি স্থাপন করা হয় তাহলে সেখান থেকে মানুষ শতভাগ নিশ্চিত সুফল পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলায় প্রতিষ্ঠিত। এই হাসপাতালে এখন লেজার থেরাপির মাধ্যমে কিডনির পাথর অপারেশন, কিডনি ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। 

স্থাপিত হচ্ছে ক্যাথ ল্যাব, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র, নিজস্ব অক্সিজেন উৎপাদন প্লান্টসহ আধুনিক চিকিৎসাসেবার বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি। গত প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই সাতক্ষীরার দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে এসে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

সেই ঘোষণা কাজে লাগিয়ে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপির প্রচেষ্টায় ২০১১ সালে শহরের কাটিয়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭ সালে নিজস্ব নতুন ভবনে শুরু হয় হাসপাতালের আংশিক চিকিৎসা কার্যক্রম। 

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত বছর অক্টোবর থেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ পর্যায়ক্রমে ২৫০ বেড হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু কিন্তু ২৫০ শয্যা হাসপাতালে যে পরিমাণের চিকিৎসক থাকার কথা তা বর্তমানে নেই, যে কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা প্রতিদিনের উপচেপড়া রোগীর চাপে বেসামাল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ৫০০ বেড হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। প্রশাসনিক অনুমোদনও দেয়া হয়েছে ৫০০ বেড হাসপাতালের। এখন জনবল নিয়োগ সম্পন্ন হলে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল। 

৫০০ বেড হাসপাতাল চালু করতে কোনো সমস্যা হবে কি-না— এ সম্পর্কে সামেক আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আহমেদ আল-মারুফ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বর্তমানে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে যে জনবল ও ডাক্তার থাকার কথা ছিলো এখন সেটি না থাকায় জনগণকে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। 

সঠিকভাবে জনবল ও চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলে আর কোনো সমস্য হবে না বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে সামেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই খোদার কাছে সামেক ৫০০ বেড হাসপাতালে উত্তীর্ণ হলে সেটি চিকিৎসাসেবা দানে তেমন কোনো অসুবিধা হবে কি-না— এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫০০ বেড হাসপাতাল চালাতে যে পরিমাণ জনবল ও চিকিৎসক প্রয়োজন হবে সেটি আমরা মন্ত্রণালয়কে অবগত করেছি। মন্ত্রণালয় যদি জনবল ও চিকিৎসক সঠিকভাবে নিয়োগ দেয় তাহলে কোনো সমস্য থাকার কথা নয়। আমরা জনবল চেয়েছি এক হাজার ২৬৭ জন, অনুমোদন দেয়া হয়েছে মাত্র ১৮৫ জন। তারা এখনো পদায়ন হয়নি, অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ২৫০ শয্যা হাসপাতাল চলা অবস্থাতেই যে পরিমাণ চিকিৎসক থাকার কথা ছিলো সেখান থেকে ২৭ জন ডাক্তার নেই। এ অবস্থাতে প্রতিদিন তিন-চারশ রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই জনবল থাকলে কোনো কিছুতেই ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। সামেকের সাবেক প্রিন্সিপাল ডা. এস জেড আতিকের কাছে জানতে চাওয়া হয় তার অভিজ্ঞতার আলোকে যেহেতু তিনি প্রিন্সিপাল থাকাকালীন সময়ে বেশির ভাগ চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি আমদানি বা ক্রয় করা হয়েছিল, সে কারণে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় সামেকের চিকিৎসায় ব্যবহূত যন্ত্রপাতির গুণগত মান সম্পর্কে। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাসপাতালে ব্যবহূত সকল যন্ত্রপাতি বিশ্বমানের, কিন্তু এখানে একটি কথা না বললেই নয়, তাই বলছি। 

সামেকে ২০০ থেকে ২৫০টি এসি আছে এগুলোর মাঝে মধ্যে সার্ভিসিং করা দরকার, কিন্তু এর কোনো টেকনিশিয়ান নেই, এককথায় এখানে যে সকল চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি রয়েছে তার কোনো টেকনিশিয়ান নেই। বিশ্বমানের এ সকল যন্ত্রপাতি সঠিক সময়ে সার্ভিসিং বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার, তা না হলে বিকল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি সঠিকভাবে টেকনিশিয়ান দিয়ে নিয়মিত পরিপাটি রাখা হয় তাহলে এগুলো দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব। 

তিনি আরও বলেন, এখানে হার্টের চিকিৎসার জন্য একটি এনজিওগ্রাম মেশিন খুবই জরুরি ছিলো, সেটি আনাও সম্ভব ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন সংগঠনের তদারকি ভুল তথ্য প্রচার করে ঝামেলা সৃষ্টি, সেটি এড়িয়ে যেতে কর্তৃপক্ষ এনজিওগ্রাম মেশিন আনতে বিরত থাকে। 

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা গেছে, বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ মানুষ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বেশির ভাগ যে কারণে মাথার অপারেশন বা চিকিৎসার জন্য সামেকে একজন কার্ডিয়াক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ খুবই জরুরি ও নিউরো সার্জারির জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার। যে কারণে বলবো, ইতোমধ্যে নিউরো সার্জারি বিষয়ে পাস করে এসেছেন ডা. হাসনুজ্জামান ও নুর মোহাম্মদ পলাশ। তাদেরকে সামেকে পদায়ন করলে চিকিৎসাসেবায় আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে সামেক বলে তিনি বিশ্বাস করেন। 

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শহরের সরকারি চাকরিজীবীসহ সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললে তারা বলেন, এই সাতক্ষীরায় যে এত বড় একটা মেডিকেল কলেজ পাবো এটা আমরা কল্পনাও করিনি। আমাদের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। আমাদের একসময় রোগী নিয়ে খুলনা-যশোর যেতে হতো, ভারতে যেতে হতো তা থেকে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি। 

কালিগঞ্জ থেকে আসা রকিবুল হাসান বলেন, আমি আগে ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। আমি জানতাম না সাতক্ষীরায় মেডিকেল কলেজ হয়েছে। জানার পর এখন এখানে আসি। এখানকার চিকিৎসার মান খুবি ভালো। দেবহাটার তরিকুল বলেন, বাংলাদেশ সরকার এত বড় একটা মেডিকেল আমাদের উপহার দিয়েছে এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। প্রত্যন্ত সুন্দরবন এলাকার-গরিব অসহায় মানুষ এখানে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। 

এ জন্য ডা. রুহুল হক এমপির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তারা। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, ডাক্তাররা সুনাম অর্জন করেছেন, তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি— বরিশাল, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনাঞ্চল থেকে রোগী এসে সাতক্ষীরায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। এটা সামেককে গর্বিত করেছে। এ জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। 

বাংলাদেশের টাকা ভারতে গিয়ে চিকিৎসার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় যাতে না হয়, সেই অবস্থা যাতে সৃষ্টি হয়, এটাই আমাদের দাবি। তিনি আরও বলেন, আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি সাতক্ষীরায় মেডিকেল কলেজ হবে। আজ সেটি হয়েছে। এখন আমরা এটা ভাবতে পারি, এই মেডিকেলে ভারতের লোকজনও আগামীতে চিকিৎসা নিতে আসতেও পারে। 

সাতক্ষীরা মেডিকেলের একাধিক শিক্ষক ও চিকিৎসক জানান, সাতক্ষীরা থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র দুই ঘণ্টার। যশোর-খুলনার দূরত্বও প্রায় একই। ফলে এখানকার বহু মানুষ এতদিন চিকিৎসার জন্য কলকাতা বা যশোর-খুলনার ওপর নির্ভরশীল ছিলো। সামেক চালু হওয়ার পর সেই নির্ভরতা কমতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, এখন খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলার রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। বিগত কোভিড-১৯ এর ব্যাপক সংক্রমণকালে ঢাকা চট্টগ্রামের মানুষও সাতক্ষীরা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে।