Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বন্ধুত্বের আড়ালে প্রতারণার ফাঁদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জানুয়ারি ১২, ২০২২, ০৮:১৫ পিএম


বন্ধুত্বের আড়ালে প্রতারণার ফাঁদ

ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রথমে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য বিদেশি নাগরিকরা। এরপর গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে দেশি প্রতারকদের সহযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে অভিনব প্রতারণায়। 

তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করতে থেকে যাচ্ছে এ দেশে। প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা প্রথমে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়। 

এরপর বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। দামি উপহার, পার্সেল, অতি মূল্যবান সামগ্রী দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব করে মূল্যবান উপহার (পার্সেল) পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎকারী সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। 

গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এমন তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে টাকাকে ডলারে রূপান্তরিত করা এবং পার্সেল পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মাদকসহ ১৫-২০ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৪। 

সমপ্রতি আমরা ফের তথ্য পাই একই কায়দায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে দামি উপহার পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত্ত রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটটি পাসপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, তিনটি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেন ড্রাইভ ও নগদ ৯৫ লাখ ৮১৫ টাকাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার কর হয়। 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন, ইফুন্যা ভিভিয়ান নাবুইকে, সানডে শেডেরাক এজিম, চিনেদু মোসেস নাজি, কলিমস ইফেসিনাছি তালিকে, চিদিম্মা এবেলে আইলোফো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা। দেশীয় দুজন হলেন ফেনীর নাহিদুল ইসলাম ও তা স্ত্রী নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার। প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক পরিচয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়ায়। 

এরআগে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত মানুষদের ভিকটিম হিসেবে টার্গেট করে। ভিকটিম নির্ধারণের পর তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। ভিকটিমের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে।  

বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানায় তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে কিন্তু তারা তা খরচ বা নিজেদের দেশে নিতে পারছে না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চায় এবং পরবর্তীতে নিবে বলে জানায়। 

চাকরিজীবীদের বলে, তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ে অর্থ লগ্নি করার কথা বলে এবং ভিকটিমকে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমিশন দেয়া হবে বলে জানায়। এতে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রতারিত হয়। ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। 

উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করলে একপর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলে, আমি তোমার নামে একটি দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি। 
পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের এ দেশের নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলে তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে পরিশোধ করতে হবে। 

যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হবে। নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদের মামলার ভয়ভীতি দেখানো হয়। বাংলাদেশি সহজ সরল মানুষ তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে, কখনো মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছে। 

মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে ঢাকার পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে। গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এ অভিনব প্রতারণার সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ এবং গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের নামে পূর্বের মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার হওয়া সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের এ দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় দেয়া এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল।

গ্রেপ্তার নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে এবং ২০২০ সালে তার নামে র্যাব-৪ কর্তৃক প্রতারণার মামলা হওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সে নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। সে এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের প্রধান। দক্ষিণ আফ্রিকান এনটোম্বিখোনা গেবুজা ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে। তার ভিসার মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত। সে নিজেকে রুবেনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়।  দেশি প্রতারক নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করে। 

২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করে। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া গিয়ে ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসে। সে গ্রেপ্তার হওয়া সোনিয়া আক্তারের স্বামী। সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি অ্যাম্বাসিতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিতে চাকরি করে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। 

প্রতারণার কাজে সহযোগিতার জন্য রুবেন ভিকটিম প্রতি ২৫ শতাংশ অর্থ সোনিয়াকে দিত। সোনিয়ার নিজের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি এবং একটি প্রাইভেটকার আছে। সোনিয়া ও নাহিদুল নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে উত্তরার জসিমউদ্দীন এলাকায় মাসে ও সপ্তাহে দুই-তিনবার দেখা করত। গত এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ জন ভিকটিমকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে সোনিয়া।