Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫,

নির্মম পেসমেকার বাণিজ্য!

জুন ১১, ২০১৭, ০৭:৩৬ এএম


নির্মম পেসমেকার বাণিজ্য!

  হার্টে বা হৃৎপিন্ডে শুধু রিং পরিয়েই নয়, পেসমেকার লাগিয়েও নির্মম চিকিৎসা বাণিজ্য চলছে। কখনও প্রয়োজনে, কখনও অপ্রয়োজনেও পেসমেকার লাগিয়ে মোটা অংকের কমিশন নিচ্ছেন কোনো কোনো হৃদরোগ চিকিৎসক। এমনও শোনা যাচ্ছে ডবল চেম্বার পেসমেকারে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন আদায় হচ্ছে। একদিকে চিকিৎসকদের কমিশন, অন্যদিকে কোম্পানির অতিরিক্ত দাম– এ দুই নির্মমতার কারণে পেসমেকার কেনার খরচ বহন করতে গিয়ে রোগীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্ত রোগীরা ভিটেমাটি বিক্রি করে নিঃস্ব। অনেক রোগী পেসমেকারের বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে ধার-কর্জ করছে। কেউ কেউ দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, চিকিৎসকরা আদর্শবান হলে রোগীদের এতটাকা বাড়তি খরচ হতো না। সর্বস্বও হারাতে হতো না। এই কমিশন বাণিজ্য অমানবিক ও নির্মম। এমন অবস্থা ছিল রিং পরানোর ক্ষেত্রেও। কিন্তু সম্প্র্রতি সরকার দাম নির্ধারণ করায় রিংয়ের দাম অনেক কমেছে, চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যও আগের মতো রমরমা নেই। কিন্তু কৌশলে এখনও কিছু কোম্পানি আগেরমতোই অতিরিক্ত মূল্য নিচ্ছে এবং চিকিৎসকরাও বেশি কমিশন লাভের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে না দেওয়ায় রোগীদের কাছে পেসমেকার বিক্রি করা হচ্ছে চড়া দামেই। আবার কমিশন সুবিধা পুরোপুরি পাচ্ছেন বলে পেসমেকার লাগানোর জন্য চিকিৎসকরা আগ্রহও দেখাচ্ছেন বেশি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পেসমেকার লাগানোর জন্য কতিপয় চিকিৎসকের অতিউৎসাহের কারণ রিংয়ের তুলনায় এতে কমিশন বেশি। একটি রিংয়ের যেখানে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা দাম, সেখানে একটি পেসমেকার ৬৫ হাজার থেকে ১২ লাখ টাকা। যত দাম, তত কমিশন, তত মুনাফা। রোগীর আত্মীয় স্বজন প্রায়ই অভিযোগ করছেন রিংয়ের মতো পেসমেকার লাগানোর জন্য অতিউৎসাহ দেখাচ্ছেন কিছু চিকিৎসক। গত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে এমনই একটি অতিউৎসাহের ঘটনা ঘটেছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমানের অধীনে ভর্তি হয়েছিলেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ তারামিয়া চৌধুরী। তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে হাসপাতালের নিজস্ব একটি টিপিএম (অস্থায়ী পেসমেকার) লাগানো হয় এবং বলা হলো দ্রুত টাকা জোগাড় করে পেসমেকার লাগাতে হবে। তারামিয়ার আত্মীয়-স্বজন যতই টাকা নেই এবং পেসমেকার লাগানো সম্ভব নয় বলছিল, ডাক্তাররা ততই পেসমেকার লাগানোর তাগিদ দিচ্ছিলেন। তারামিয়ার পরিবার অনুরোধ করল তাকে ছুটি দিতে। ডাক্তাররা বলল যন্ত্রটি খুলে দিলে যেকোনো সময় তারামিয়া মারা যাবে। স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে লিখিত দিয়ে যেতে হবে। এতে রাজি হওয়ার পরও তিনদিন বেডে শুয়েছিলেন তারামিয়া। পরে তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. এসটিএম আবু আজম যন্ত্রটি খুলে দিয়ে তারামিয়াকে ছুটি দেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপরও একদিন দেরি করা হয়। অবশেষে তারামিয়া সুস্থভাবেই বাড়ি ফিরে যান। শুধু রোগী ও তার আত্মীয় স্বজনই এরকম ভুক্তভোগী– এমন নয়, পেসমেকার লাগানোর ক্ষেত্রে সন্দেহ করতে দেখা গেছে খোদ চিকিৎসকদেরও। এসব চিকিৎসক নিজেদের বা অন্যকোনো রোগীর হার্টে পেসমেকার পরানোর আগে হৃদরোগ চিকিৎসকদের অতিউৎসাহের সমালোচনা করতে দেখা গেছে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, স্কয়ার, ইউনাইটেড, আল হেলাল, অ্যাপলো ও সিকদার হাসপাতালসহ হৃদরোগ চিকিৎসাকেন্দ্র আছে এমন বিশ্বের অনেক হাসপাতালেরই কিছু না কিছু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অপ্রয়োজনে হার্টে রিং, পেসমেকার, ডিভাইস পরাচ্ছেন বলে আলোচনা হচ্ছে। তাতে সবথেকে বেশি সন্দেহ হচ্ছে হৃদরোগীদেরই। এ মুহূর্তে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পেসমেকার সরবরাহ নেই। অন্য সময় পাওয়া যেত। কিন্তু কমদামি এবং রোগীর সংখ্যার তুলনায় ছিল নগণ্য। কাড়াকাড়ির মধ্যে কেউ পেত, কেউ বঞ্চিত হত। তাছাড়া বিত্তবানরা পেসমেকার কমদামি বলে লাগাতে চায়ও না। তাই এখন সরকারি হোক আর বেসরকারি হাসপাতাল হোক, হৃদরোগীর প্রয়োজন কোম্পানির পেসমেকার। বাণিজ্যটা শুরু এখানেই। তবে এ কথা ঠিক যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বস্তু লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। এগুলো লাগানোর পর রোগী অনেকদিন বেঁচেও থাকেন। আবার এমনও হার্ট ফেইলিয়রের রোগী আছে, যাদের পেসমেকারের প্রয়োজন নেই, ওষুধই যথেষ্ট। কিন্তু কিছু অর্থলোভী চিকিৎসক পেসমেকার লাগাতে মরিয়া। কখনও প্রয়োজনে এবং কখনও অপ্রয়োজনেই বিশ্বাস করে এগুলো লাগাতে রাজি হচ্ছেন রোগী এবং স্বজনরাও।

পেসমেকার লাগিয়ে কমিশন নেওয়ার অভিযোগের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন– বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ডা. জাহিদুল হক বসুনিয়ার কাছে কয়েকদিন আগে জানতে চেয়েছিলেন আমার সংবাদ প্রতিবেদক। জবাবে তিনি বলেছেন, এমন অভিযোগ পাননি। পেলে অবশই তদন্ত করবেন এবং প্রমাণ পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, হার্টের একটি নিজস্ব পেসমেকার আছে। এটি কোনো কারণে নষ্ট হলে হৃদস্পন্দন কমে যায়। তখন এই অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেসমেকার লাগাতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে পেসমেকার না লাগিয়ে ওষুধেও হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক করা সম্ভব। বুকের নিচে সামান্য কেটে পেসমেকার লাগানো হয়। পেসমেকারে থাকা তার শিরার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডে যুক্ত হয়ে হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ায়।