Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

অ্যানাল ফিসারের কারণ ও হোমিও প্রতিকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০, ০৬:১৭ পিএম


অ্যানাল ফিসারের কারণ ও হোমিও প্রতিকার

পায়ুপথের সব রোগই সাধারণ মানুষ পাইলস মনে করে থাকেন। কিন্তু পাইলস ছাড়াও পায়ুপথে অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। যেগুলোর মধ্যে অ্যানাল ফিসার একটি। এ রোগে মূলত পায়ুপথ ছিঁড়ে যায়।

আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষ মলদ্বারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগেন। মলদ্বারে ঘা অথবা ফেটে যাওয়া। এটি দুই ধরনের হয়। তীব্র (একিউট) ফিসার হলে রোগীর মলদ্বারে অসম্ভব ব্যথা হয়। দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) ফিসারে ব্যথার তারতম্য হয়।

এটি যেকোনো বয়সে হতে পারে। যেমন— পাইলস, অ্যানাল ফিসার, ফিস্টুলা ইত্যাদি। কিন্তু অনেকেই বিশেষ করে মহিলারা এ রোগগুলোকে গোপন স্থানের সমস্যা মনে করেন এবং মলদ্বারের রোগের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী থাকেন। ফলে অনেকেই গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরেও কবিরাজ কিংবা অনভিজ্ঞ লোক দ্বারা অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন।

মলদ্বারের বা পায়ুপথের রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অ্যানাল ফিসার যা আমাদের অনেকের কাছেই ‘গেজ’ রোগ নামে পরিচিত। অ্যানাল ফিসার রোগে মলদ্বারের চামড়ার ফাটল বা চির হওয়া যা সাধারণত মল শক্ত হলে বা ঘন ঘন মলত্যাগের কারণে মলদ্বার ফেটে ঘা হয়ে থাকে।

এ রোগ বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক যে কারো হতে পারে। তবে তরুণ বা মাঝবয়সিদের এ রোগ বেশি হয়। পুরুষ কিংবা নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই এ রোগ সমানভাবে হয়। মলদ্বারের ব্যথায় অনেকেই ভোগেন।

অ্যানাল ফিসারের কারণ : এ রোগ হওয়ার জন্য দায়ী সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা মলত্যাগের সময় কোত দেয়া। এছাড়া শক্ত মল বের হওয়ার সময় মলদ্বার  ফেটে যায় বলে মনে করা হয়। যারা আঁশযুক্ত খাবার খান তাদের এ সমস্যা কম হয় বলে মনে করা হয়। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে শাকসবজি, কাঁচা ফলমূল, আলু, ছোলা, ইসবগুলের ভূসি ইত্যাদি।

চা-কফি বা মদ খাওয়ার সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ঘন ঘন মলত্যাগ বা ডায়রিয়া হলে ফিসার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মলদ্বারের ভেতরের চাপ মেপে দেখেছেন। ফিসারে চাপ তেমন একটা বাড়ে না যদিও আঙ্গুল দিয়ে পরীক্ষা করলে মলদ্বার অতিরিক্ত সংকুচিত বলে মনে হয়।

অ্যানাল ফিসারের উপসর্গ : মলদ্বারে ফিসারের প্রধান লক্ষণ ব্যথা ও রক্তক্ষরণ। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত মলত্যাগের অব্যবহিত পরে হয় এবং কয়েক মিনিট থেকে বহু ঘণ্টা ধরে ব্যথা চলতে পারে। প্রকটালজিয়া ফুগাক্স নামক এক ধরনের  রোগেও মলদ্বারে ব্যথা হয়, কিন্তু সে ব্যথা মলত্যাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে না। রক্ত জমাটবাধা পাইলসেও ব্যথা হয়, কিন্তু তখন রোগী মলদ্বারে চাকা আছে বলে অভিযোগ করে।

এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত কম। কারো কারো অতিরিক্ত রক্ত যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) অ্যানাল ফিসারের রোগী একটু ভিন্ন ধরনের উপসর্গের কথা বলে। তারা কখনো কখনো তাদের মলদ্বারে অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড, পুঁজ পড়া, চুলকানি অথবা এসব একত্রে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ থাকতে পারে অথবা নাও থাকতে পারে। ব্যথা সাধারণত তীব্র হয় না অথবা অনেক সময় ব্যথা থাকেই না।

ফিসারের রোগীরা অনেক সময় প্রস্রাবের সমস্যায় ভোগেন এবং মহিলারা কখনো কখনো শারীরিক মিলনে বেদনা অনুভব করেন; যদিও রোগীরা বুঝতে পারেন কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণেই এমন হয়েছে তবুও যখন ব্যথা শুরু হয় তখন রোগী ভয়ে টয়লেটে যেতে চান না এবং মলত্যাগের বেগ হলে তাতে ব্যথার ভয়ে সাড়া দিতে চান না।

একিউট ফিসার : এ সময় মলদ্বার পরীক্ষা করলে দেখা যায় সেটা খুবই সংকুচিত অবস্থায় আছে। তীব্র ব্যথার কারণে মলদ্বারের ভেতরের ঘা-টি দেখা দুঃসাধ্য। কোনো যন্ত্রও প্রবেশ করানো যায় না। অবশ্য সর, যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা যায়।

ক্রনিক ফিসার : এ ক্ষেত্রে একটি মাংসপিণ্ড বা ‘গেজ’ দেখা যায়। মলদ্বারের ভেতরেও একটি মাংসপিণ্ড দেখা যেতে পারে যাকে অনেকে টিউমার বলে ভুল করে। এ ক্ষেত্রে পায়ুপথের ভেতর যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত যাতে টিউমার বা প্রদাহজনিত কারণ চিহ্নিত করা যায়। এ ফিসার সংক্রমিত হয়ে কখনো কখনো ফোঁড়া দেখা দিতে পারে এবং তা থেকে ফিস্টুলা (ভগন্দর) হয়ে পুঁজ পড়তে পারে।

অ্যানাল ফিসারে সমস্যা হলে কি খাবেন:  * যারা আঁশযুক্ত খাবার খান তাদের এ রোগ কম হয়। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক-সবজি, কাঁচা ফলমূল, আলুর ছোলা, ইসপগুলের ভুসি ইত্যাদি। এতে থাকা আঁশ মলে পানি ধরে রেখে মলকে নরম করে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবনা থাকে না।

* ডালজাতীয় খাবার খান। এক কাপ ডালে ১৫-১৬ গ্রাম আঁশ থাকে। দিনে অন্তত দুই কাপ ডাল খান।

* খোসাহীন শস্যের চেয়ে খোসাযুক্ত শস্য খান। সাদা চাল বা আটার বদলে লাল চাল বা আটা খান। খোসা, প্রচুর আশ ও ভিটামিন সরবরাহ করে।

* নিয়মিত দই খান। এতে থাকা উপকারী ব্যাক্টেরিয়া কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সহায়তা করে।

* দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি খান।

অ্যানাল ফিসারের সমস্যা হলে কি খাবেন না : * পাস্তা, ক্র্যাকার, ভাত, বিস্কিট, রুটি ইত্যাদিতে আঁশ অনেক কম। ধরুন আপনি এক বেলার খাবারে নিয়মিত পাস্তা খান বা এক প্যাকেট বিস্কিট খান বা অল্প পরিমাণ সব্জি দিয়ে বা সব্জি ছাড়া প্রচুর রুটি বা ভাত খান— এ ধরনের খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত থাকলে কিন্তু আপনার শরীরে আঁশ গ্রহণ কম হচ্ছে। ফলে দেখা দিতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য। মোটকথা কোষ্ঠকাঠিন্য নিরোধে কার্বোহাইড্রেটের সঙ্গে আঁশের অনুপাত ঠিক থাকতে হবে।

* ফ্যাটি ও উচ্চ সুগারযুক্ত খাবার নিয়মিত গ্রহণের অভ্যাসও কোষ্ঠকাঠিন্য ঘটাতে পারে। যেমন— গরুর মাংস, চিজ, মাখন, ফ্রাইড খাবার, চকোলেট, আইস্ক্রিম, কোমল পানীয় ইত্যাদি।

অ্যালান ফিসার রোগীর ব্যায়াম : যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে তারা ব্যায়ামের মাধ্যমে কমাতে পারেন। ফলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনাও কমে। মাটিতে সোজা হয়ে পড়ুন, পা মাটিতে মেশানো থাকবে, পায়ের পাতা ছাদমুখী থাকবে। এবার পেটের পেশি ভিতরের দিকে টেনে ধরে আস্তে আস্তে শ্বাস নিন ও ডান পাটা আস্তে আস্তে দূরে নিন। যতদূর পারেন করুন, এরপর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পা আগের জায়গায় আনুন। এরপর বাম পা ব্যবহার করে একই ব্যায়াম করুন।

মলদ্বারের যত্ন : মলদ্বার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখুন। সুতী ও ঢিলেঢালা অন্তর্বাস পরিধান করুন। অন্তর্বাসের ভিতরে নরম কোনো প্যাড ব্যবহার আপনাকে স্বস্তি দেবে। মাঝে মাঝেই সিজ বাথ  নিন, এটির নিয়ম হচ্ছে আধ গামলা লবণ মিশ্রিত গরম পানিতে নিতম্ব ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে।

হোমিও সমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। হোমিওপ্যাথিতে অ্যানাল ফিসারের জন্য ৫০টিরও বেশি ওষুধ ব্যবহার হয়। এ জন্য চিকিৎসককে রোগীর বর্তমান কষ্ট, মানসিক, সার্ব দৈহিক ও চরিত্রগত লক্ষণাবলি মূল্যায়ন করে যেকোনো একটি ওষুধ পরিবর্তিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

এ পদ্ধতিতে ওষুধ নির্বাচন যদি সঠিক হয়, তাহলে, অ্যালোপ্যাথির সকল সার্জিক্যাল রোগ, অ্যানাল ফিসারসহ যেকোনো জটিল রোগ স্বল্প সময়ে হোমিওপ্যাথিতে আল্লাহর রহমতে স্থায়ীভাবে নির্মূল সম্ভব।

লেখক : কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র

আমারসংবাদ/এআই