Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

স্মৃতিশক্তি নিরাময়ে হোমিওসমাধান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

অক্টোবর ২১, ২০২০, ০৬:৫৪ পিএম


স্মৃতিশক্তি নিরাময়ে হোমিওসমাধান

স্মৃতিশক্তি আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজন তা বলার অবকাশ থাকে না। সকল শক্তির উৎস মহান সৃষ্টিকর্তা। স্রষ্টার সকল সৃষ্টির মাঝেই শক্তি বিদ্যমান। শক্তির কারণেই সমগ্র সৃষ্টি ক্রিয়াশীল। শক্তিহীন মানে মৃত, ধ্বংস, মূল্যহীন। স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া একটি বিরক্তিকর মানসিক সমস্যা। শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্কের পুষ্টির জন্য সুষম খাবার অত্যন্ত জরুরি।

মস্তিষ্ক সঠিক পুষ্টি না পেলে অনেক ক্ষেত্রেই স্মৃতিভ্রমসহ আরও নানান সমস্যা দেখা দেয়। তবে খাদ্যাভ্যাস ছাড়া আরও বেশকিছু কারণে দুর্বল স্মৃতিশক্তির সমস্যা দেখা দিতে পারে। আজ স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ডা. এম এ মাজেদ।

তিনি তার কলামে লিখেন— সমপ্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্বজুড়ে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ বৃদ্ধি সম্পর্কে ভয়ঙ্কর তথ্য প্রদান করেছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, বিশ্বে স্মৃতিশক্তি সমস্যাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা চার কোটি ৭৫ লাখ।

প্রতি বছর এই দলে যুক্ত হচ্ছে আরও ৭০ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। বর্তমানে মানুষের মস্তিষ্কের কোষের উৎপাদনের হার নিম্নমুখী। মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং কার্যক্ষমতাকে বৃদ্ধি করবে। আমাদের সমস্যা নানাবিধ। তন্মধ্যে শিশুদের মেধার সমস্যা অন্যতম। একজন অভিভাবক চান, তার সন্তান মেধাবী হোক, শিক্ষক চান তার ছাত্র-ছাত্রীরা মেধাবী হোক। শিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের একই চাওয়া শিশুরা মেধাবী হয়ে গড়ে উঠুক। সমাজের সুধীজনদেরও একই কামনা-বাসনা।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের ব্রেন ২.৫ পেটাবাইটস ডাটা ধারণ করতে পারে। ১ পেটাবাইটস= ১০২৪ টেরাবাইটস , ১ টেরাবাইটস= ১০২৪ গিগাবাইটস। এবার ধরি, যদি একটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ১ টেরাবাইটস বা ১০২৬ জিবি হয় তাহলে ২.৫ পেটাবাইটস= ২৫৬০টি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ধারণক্ষমতার সমান। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের ব্রেনে ২৫৬০টি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের সমান তথ্য ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে।

এবার হয়তো ভাবছেন আমাদের ব্রেনে যদি এতো ধারণক্ষমতা থাকে, তাহলে আমরা মনে রাখতে পারি না কেন? ঠিক ধরেছেন, এমনটা হতে পারে স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার কারণে। গরিবের সন্তানের মেধা আছে- বিকশিত হওয়ার সুযোগ কম।

ধনীর দুলালের মেধা কম- অর্থ দিয়ে সব কেনা যায় কিন্তু মেধা কেনা যায় না। দুর্বল ও অমনযোগী ছাত্র-ছাত্রীদের অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের সুচিকিৎসায় হোমিও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে শিশুদের অমনযোগিতা দুরীকরণসহ মেধাবিকাশে সহায়ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে ভুলে যাওয়া খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে মানুষের স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। তবে সময়ের এই প্রভাবকে একটু দীর্ঘায়িত করা যায়। হার্ট, ফুসফুস, পেশির যত্নের সাথে সাথে সুস্থ থাকতে হলে খেয়াল রাখতে হবে আপনার মস্তিষ্কের দিকেও। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে।  

ছাত্র-ছাত্রীর অমনযোগী হওয়ার কারণ—
* অভিভাবককেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে তার শিশুর গঠন প্রকৃতি নিয়ে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ও আপনার শিশুর সুচিকিৎসা নেয়া।
* হোমিও চিকিৎসককে আগত শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে লক্ষণ সাদৃশ্য ও ধাতুগত চিকিৎসা প্রদান করে অমনযোগী ও অমেধাবী শিশুকে সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
* সমাজের অভিভাবক সমাজ ও সচেতন মানুষদের পদক্ষেপ নিতে হবে- তাদের সমাজের শিশুদের অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে শিশুর চিকিৎসা নেয়ার জন্য সমাজে সচেতনতা গড়ে তোলা।
সাধারণ কিছু কারণ : হস্তমৈথুনজনিত কারণে, মদ্যপানজনিত কারণে, বার্ধক্যজনিত কারণ, অতি বাচাল-মানসিক উত্তেজনার কারণে।

খাদ্য দিয়ে স্মরণ শক্তির চিকিৎসা : খাদ্য খাইলে মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে। তৈলাক্ত মাছ স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বিশেষ উপকারী। যেমন- স্যামন, সার্ডিন, টুনা, ম্যাকরেল প্রভৃতি মাছ নিয়মিত খাওয়া উচিত।

মাছের চর্বি : মাছের চর্বিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা মস্তিষ্ক গঠন ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক। অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য গর্ভবতী নারীদের সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন মাছ খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। মাছ শিশুর মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। স্যামন এবং টুনা মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সবচেয়ে ভালো উৎস।

টমেটো : টমেটো স্মৃতিশক্তি সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। টমেটোতে রয়েছে লাইকোপেন, যা খুবই শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। নিয়মিত খাবারের সঙ্গে সালাদ হিসেবে টমেটো খেলে তা মস্তিষ্কের পক্ষে বিশেষ উপকারী।

ভিটামিন ‘বি’ সমৃদ্ধ খাবার : ভিটামিন বি, বি৬, বি১২ সমৃদ্ধ খাবার বেশি বেশি খাওয়া প্রয়োজন। মাছ, মুরগির মাংস, ডিম এবং শাক জাতীয় খাবারে এর পরিমাণ বেশি থাকে।

শস্য জাতীয় খাবার : শস্য জাতীয় খাবার, বাদাম, ব্রকোলি, কুমড়োর দানা মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী। এ কারণে নিয়মিত ডায়েট চার্টে এগুলো বেশি বেশি রাখা উচিত।

স্মৃতি শক্তির জন্য পরামর্শ—    
কাঠবাদাম : ৫ থেকে ১০টি কাঠবাদাম সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে খোসা ছাড়িয়ে নিন এবং একে গুঁড়া করুন। এক গ্লাস দুধের মধ্যে এই গুঁড়া মিশিয়ে ফুটান। স্বাদ বাড়ানোর জন্য সামান্য চিনি বা মধু মেশাতে পারেন। ৩০ থেকে ৪০ দিন এটি প্রতিদিন খান।

মধু ও দারুচিনি : মধু ও দারুচিনি স্নায়ুকে শিথিল করে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। গবেষণায় বলা হয়, কেবল দারুচিনি একটু নাকের কাছে নিয়ে শুঁকলেও স্মৃতিশক্তি ভালো হয়, এতে মস্তিষ্কের কার্যক্রম বাড়ে।

অনেকে এ-ও বলেন, ঘুমের আগে মধু খেলে মানসিক চাপ কমে; ঘুমেও সাহায্য হয়। এটি স্মৃতি একত্রীকরণে ভূমিকা রাখে। যা করতে হবে— এক চা চামচ কাঁচা মধুর মধ্যে এক চিমটি দারুচিনি মেশান। কয়েক মাস ধরে প্রতি রাতে এটি খান।

ডিম : যেকোনো পুষ্টিবিদই আপনাকে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিবেন। ডিমে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিগুণ। ডিমের হলুদ অংশে কোলিন (দ্রবণীয় নিউট্রিয়েন্ট) রয়েছে, যা মস্তিষ্কের জন্য বেশ দরকারি। বিশেষ করে ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে এটি ভালো কাজ করে।

শাক : শাক শরীর গঠনের খাবার হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া শাকে লুটেনিন নামে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এটি কগনিটিভ (জ্ঞান অর্জন ও চিন্তা করার ক্ষমতা) পতন প্রতিরোধ করে। লুটেইন মস্তিষ্কের প্রধান কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতার উন্নয়ন করে।

কালো চকোলেট : এতে প্রাকৃতিক উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী উপাদান এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। পরিমিত মাত্রায় চকোলেট খেলে এরমধ্যে থাকা ক্যাফেইন আপনার মস্তিষ্ক এবং মেজাজ স্বাভাবিক রাখবে।

ব্যায়াম : স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিকারক এসব খাবার গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির ব্যায়াম করা যেতে পারে। আর অবশ্যই প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াও জরুরি।

মস্তিষ্কে খেলা খেলুন : নিয়মিত ব্রেনের কাজ করলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। সুডোকো কিংবা ক্রসওয়ার্ডস খেলাসহ ব্রেনের ব্যায়াম হয় এমন খেলা খেললে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায় সেই সঙ্গে মস্তিষ্ক অধঃপতন হওয়া থেকে রক্ষা করে।

পরিমিত ঘুম : ঠিকমতো ঘুম না হলেও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। ঘুমের সময়ের ওপর স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও বৃদ্ধি পায়। দৈনিক আট ঘণ্টা গভীর ঘুম হলে স্মৃতিশক্তি অস্থায়ী থেকে দীর্ঘমেয়াদি হবে।

হোমিওসমাধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। হোমিওপ্যাথি হলো সুস্থ শরীরে কোনো একটি ওষুধ প্রয়োগ করলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়, কোনো পীড়ায় সেই সমস্ত লক্ষণ প্রকাশিত হলে সেই পীড়ার ওই ওষুধ সূক্ষ্ম মাত্রা দ্বারা চিকিৎসা করাকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বলে।

সদৃশ্য বিধান মতে চিকিৎসা, শুধুমাত্র সাদৃশ্য হলেই প্রকৃত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হয় না। এর জন্য অর্গান অব মেডিসিন বা হোমিওপ্যাথির জনক ডা. স্যামুয়েল হানেমানের রচনা অনুসরণ করতে হবে। হোমিওপ্যাথিতে শারীরিক লক্ষণের চাইতে মানসিক লক্ষণের গুরুত্ব বেশি দিয়ে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়।

হোমিওপ্যাথির মূলনীতিতে এবং হোমিও ওষুধের গুণাবলী বিশ্লেষণে মানসিক লক্ষণের এতোই ছড়াছড়ি দেখা যায় যে, যেকোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ তা অধ্যয়ন করলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন।

এবং তার মনে হতে পারে যে, হোমিওপ্যাথি বুঝি বা আদতেই একটি মানসিক রোগ বিজ্ঞান। তাছাড়া হোমিও ওষুধের ব্যবহার বিধিও বেশ আরামদায়ক, মুখে খাওয়ালেই চলে। এমনকি যেসব মানসিক রোগী ওষুধ খেতে অস্বীকার করে তাদের পানি, দুধ, শরবত, চা, বিস্কিট, ভাত, মুড়ি বা অন্য খাবারের সাথে মিশিয়ে ওষুধ খাওয়াতে পারবেন।

হোমিও ওষুধ রোগীকে খাওয়ানো ছাড়াও বিকল্প পদ্ধতিতে যেমন- আঘ্রাণ, চামড়ায় মর্দন, চুলে,  প্রভৃতি পদ্ধতিতে হোমিও ওষুধ প্রয়োগ করতে পারবেন; রোগী জানতেই পারবে না যে তাকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে।

হোমিওচিকিৎসা : অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য যেসব ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন— সালফার, অরামটোলিকাম, নাক্স ভমিকা, টিউবারকুলার, মেডোরিনাম, জিংকাম মেটালিকাকাম, বিউফো রানা, এনাকার্ডিয়াম, কার্বোভেজ, এসিডফস, ব্যারাইটা কার্ব, কোনিয়াম, ক্যাল-কার্ব, ল্যাকেসিস, থুজাসহ আরও অনেক মেডিসিন লক্ষণের ওপর আসতে পারে। তাই ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে বিশেষজ্ঞ হোমিওচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

লেখক : কো-চেয়ারম্যান : হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র

আমারসংবাদ/এআই