Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

একটি সুখ সংবাদ

মহসীন চৌধুরী জয়

জুন ১১, ২০১৯, ০৩:৫৭ এএম


একটি সুখ সংবাদ

একটি সুখ সংবাদ! একটি সুখ সংবাদ! জোড়পুল নিবাসী মো. বাবুল আহমেদের বাবা লতিফ আহমেদ বার্ধক্যজনিত কারণে আজ সকাল নয় ঘটিকায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিওন। মৃত্যু কালে তাহার বয়স হইয়াছিল পঁচাশি বৎসর। মরহুমের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হইবে বাদ আসর জোড়পুল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে। আপনারা দলে দলে যোগদান করিয়া মরহুমের মাগফেরাত কামনা করুন।

প্রথমবার ঘুমের ঘোরেই শুনছিল নবীন। দ্বিতীয়বার মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিন সাহেবের শ্রুতিকটু কণ্ঠের ‘সুখ সংবাদ’ শুনে ঘুম ভেঙে গেল সহসা। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসিও জেগে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে। মৃত ব্যক্তির প্রয়াণের শোককে মুয়াজ্জিন সাহেব দুর্বল উচ্চারণে কিরকম সুখে পরিণত করতে পারে, এমনটা ভেবেই এ হাসির জন্ম। মৃত্যু সংবাদ আসলে কী শোক নাকি সুখ সংবাদ? তিরিশে পৌঁছে যাওয়া তরতাজা নবীন মৃত্যু নিয়ে আর ভাবতে চায় না। জীবন এখন প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে ওর সঙ্গ চাচ্ছে। এই তুঙ্গস্পর্শী জীবনে জরা, হতাশা, দুঃখ কিংবা মৃত্যু বলে কিছু নেই। অনাকাক্সিক্ষত এরকম কিছু থাকতেও পারে না। যৌবনের জীবন মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরম সুখে পৃথিবীতে মেতে থাকে।

সদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠা মারিয়া নবীনকে টানছে খুব। মারিয়ার শরীরের ঘ্রাণ নিতে নবীন অস্থির। নারী শরীর দূর থেকে শুধু মোহ জাগিয়ে বিদায় নেয়। ছুঁয়েও দেখা যাবে আজ। একান্ত নারীকে প্রথম স্পর্শ করা কি সাগর জয়ের আনন্দের চেয়ে কম? চোখে চোখ রেখে ডুবে যাবে অতলে। উড়ন্ত চুলের নৃত্য দেখবে। বুকের স্পন্দন শুনবে। হাতে হাত রেখে মুখের মানচিত্রে খুঁজে নেবে পৃথিবীর বিস্ময়। এই সুখ উদযাপনে মৃত্যুর স্থান কোথায়? এখানে শুধুই জীবনের গল্প। এ ভাবনার স্থায়িত্ব হোক-না হাজার বছর—কী এক বিচিত্র উষ্মা অনুভূত হয় দেহের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে, শিরায় শিরায়।

মারিয়াদের বাড়ি মধ্যবিত্ত পরিবারের নিপুণ এক চিত্রকর্ম যেন। বাবা প্রবাসে, মা গৃহিণী। ছোট ভাইটা বাইরের খেলা নিয়ে সারাদিন মেতে থাকে। তারপরও পরিবারের একাকিত্ব ওকে দখল করে নিয়েছে এমনটা ভাবা অর্থহীন। আদতে যৌথ পরিবারের বার্ধক্য ওর ঘাড়ে প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাস ফেলছে মৃত্যুময় যন্ত্রণায়। মৃত দাদার একমাত্র ছেলে মারিয়ার বাবা। অথচ দাদার ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে এবং তাদের ছেলে-মেয়েতে পুরো বাড়ি ঠাসা। দাদার ভাইকে নবীন চিনে। রহমত উল্লাহ যেমন বদরাগী তেমনি গোঁয়ার। বার্ধক্য, জরা, মৃত্যুর অপর রূপ।

মারিয়া প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসে। এই যে পাঠ করে যাওয়া বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো, এ কি শুধুই বর্ণে বর্ণে অক্ষরের মিলন? অক্ষরে অক্ষরে শব্দের প্রেম? বর্ণ, অক্ষর, শব্দে যে ব্যঞ্জনা তৈরি হয় বাক্যের শরীরে, ভাবনায়, বোধে সেখানে জীবনের ভেতর অজস্র জীবন কি উঁকি দেয় না? অজস্র চরিত্রে ভাবের বিনিময় কি হয় না? আদতে বই জীবনে মিশে বাস্তবতার পৃষ্ঠা হয়ে দাঁড়ায়, হয়তো জীবনও বদলে দেয়।

মারিয়াদের বাড়িতে যাবার আগে নবীন শাহবাগ যাবে। মারিয়ার জন্য বই কিনবে, প্রচুর বই। মারিয়ার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল এরকম, ‘বই না থাকলে আমার জীবন কখনোই রঙিন হতো না।’

ফতুল্লা রেলস্টেশন থেকে দুপুরের ট্রেনে কমলাপুর। তারপর রিকশায় চলে যাওয়া শাহবাগের পথে জীবনের আয়োজনে।

প্রচুর বই কিনে ফেলল নবীন। মারিয়া বিস্মিত। দশ হাজার টাকার বেশি গেল বই কেনায়। একি বই কেনা নাকি টাকার বিনিময়ে সম্পদ সংগ্রহ করা? চোখের বালি, দত্তা, অপরাজিত, যোগভ্রষ্ট’, দিবারাত্রির কাব্য, রাতভর বৃষ্টি; বইগুলোকে উপরে রাখল। আরো কত কত বই বেঁধে দিল দড়ি দিয়ে মারিয়ার জীবনে। মারিয়া আন্দোলিত। ভাবছে, বই কী? জীবনকে পড়ো না তুমি বইয়ের পৃষ্ঠায়।

দোকানের এক কর্মচারী বইগুলোকে কাঁধে করে বাইরে নিয়ে এলো। নবীন একশ টাকা বকশিস দিল ছেলেটিকে। এই বিষয়টাও মারিয়ার চোখকে বিস্মিত না করে পারেনি।

রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করল নবীন। অথচ মারিয়া বাড়িতে যেয়েই করবে বিকেলের নাস্তা। সিএনজি চালিত অটোরিকশায় একেবারে বাড়ির পথে।

মারিয়াকে নামিয়ে বিদায় নিল নবীন। অনুরোধ রক্ষা না করে ক্লান্ত মারিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেল। আসবে ফ্রেশ হয়ে। আরো কী কী উপহারের বিস্ময় নাকি অপেক্ষা করছে মারিয়ার জন্য।

নির্জন এক রুমে মারিয়াকে একা পেতে চাওয়া বোকামিই বটে। যৌথ পরিবারের জীবনযাত্রায় এ চাওয়াটা মারিয়ার জন্য শোভনও নয়। মারিয়ার মা এসেছিল একটু আগে। ভদ্রমহিলা লাজুক আর অন্তর্মুখী। সালামের উত্তর ছাড়া সেই অর্থে আর কোনো কথাই বলেননি। তবে মুখের আদল আর ভাবের সৌন্দর্য দেখে নবীনের মনে হলো, ভদ্রমহিলা এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ মেনে নিয়েছে।

নাস্তা এলো। হরেক রকম। পরিবেশনের সৌন্দর্যে নবীন মুগ্ধ। আজ নবীনের চোখে বাইরের পরিবেশ চমৎকার। বিকেলের শেষ সময়ের ঘনঘটায় নরম সন্ধ্যার আয়োজন চলছে দ্রুত। কোমল মেঘের আবহ জানলার ফাঁক দিয়ে মারিয়ার চোখ-মুখ স্পর্শ করছে। নিশ্চুপ মারিয়া। অথচ কী এক অব্যক্ত দেহভাষায় মন উজাড় করে কথা বলছে যেন। কিছু অপ্রকাশিত ভাবের গোপন রহস্য গভীর এক তাড়নার জন্ম দেয়। উৎসুক এ মন ভাবনায় ডুবে নিয়ত জেগে ওঠে অন্তরগহনে। তখন শূন্য থেকে শুরু হয় অজানার প্রতি জানার কাঙ্ক্ষিত উস্কানি। এই ইন্ধনে মন পেতে শরীরে চলে বিরামহীন ভ্রমণ, অঙ্গে অঙ্গে অনুপুঙ্খ যাতায়াত। চোখের গভীরে ডুবে যায় চোখ, হৃদয়ের অতলে কূলের সন্ধানে চলে জীবনযুদ্ধ।

নবীন চোখের পলকে সিগারেট ধরাল। সিগারেট না ধরালে ভেতরটা জাগছে না। এই দৃশ্য দেখে মারিয়া অস্থির। ভেতরে ভয়ও জেগে উঠল।

করো কী, করো কী, বাড়িতে সিগারেট ধরিয়ে ফেললে? তুমি জানো, আমাদের বাড়ির কেউই সিগারেট পান করে না? ধূমপায়ীদের পছন্দও করে না। আমাকে পেতে হলে তোমাকে সিগারেটও ছাড়তে হবে। হু, বলে রাখছি।

হু বলে রাখছি, কথাটা বলার সময় মারিয়া শরীরটাকে অদ্ভুতভাবে নাড়াল। শরীরের এ নৃত্যের প্রধান অঙ্গ মুখ আর চোখ। এ এক অপার মুগ্ধতা! দ্রুত কয়েক টানের পর সিগারেট ফেলে নবীন মারিয়ার কাছে গেল। ঘনিষ্ঠ হলো। চুম্বনের জন্য ঔদ্ধত্য মুখ বাড়াল। মারিয়া আপ্লুত, অথচ কী বিষম অস্বস্তিকর এক মুহূর্তও বটে। চুম্বনের উত্তেজনায় স্নায়ুতে প্রচণ্ড এক শক, তার ওপর সিগারেটের তীব্র আর উৎকট দুর্গন্ধ। উন্মুক্ত রুমের গোপনও নেই। ধাক্কা দিয়ে মুখ সরিয়ে দিল। এ ধাক্কাটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিল নবীন। কাঙ্ক্ষিত নারীর সান্নিধ্যে এরকম আবেগঘন সময়ে পুরুষ হয়ে যায় খেলার সামগ্রী আর নারী হয়ে ওঠে এক শক্তিমান খেলোয়াড়। তবু, যথাসম্ভব বিনয় জড়িয়ে, মুখটাকে বিকৃত-সৌন্দর্যে প্রস্তুত করে মারিয়া বলল, চুম্বনের জন্য ওষ্ঠাধর চাইতে নেই, মন চাইতে হয়।

নবীন হাসতে হাসতে আগের জায়গায় ফিরে এলো। এবার নবীনও পাকা খেলোয়াড় হতে চাচ্ছে। যেন সঙ্গপ্রেমে মন হাসে।

তোমার বাম পা টি-টেবিলের উপর রাখো তো একটু।

হেসে উঠল মারিয়া—

এ আবার কিরকম আবদার? তুমি কি পাগল হয়েছ? এটা আমাদের বাড়ি ভুলে যাচ্ছ কেন? কখন কে চলে আসবে?

যাদের আসার কথা তারা সবাই বাইরে চলে গেছে। তুমি বাম পা টি-টেবিলের উপর রাখো।

মারিয়ার পা সুন্দর। নবীনের অনুরোধে টি-টেবিলের উপর পা তুলে দিতেও আপত্তি নেই। ভালোবাসার সম্পর্ক, তবু কিরকম অস্বস্তি জাগছে মনে। ঘনিষ্ঠ হবার আগেই কি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে নবীনের আবদার? নাকি প্রেমে এরকম পাগলামি থাকেই।

শোনো, আমার হাত ধরার অধিকার অনেকের আছে কিন্তু পা ধরার অধিকার শুধুই তোমার। তবে এখন নয়, বিয়ের পর।

নবীনের হাসি পেল।

বিয়ের পর আমি কি তোমার পা ধরে বসে থাকব?

যাও, আমি কি তাই বলেছি?

লজ্জা, জড়তা দূরে ঠেলে মারিয়া বাম পা টি-টেবিলের উপর তুলে দিল। পায়ের এই উন্মুক্ত প্রকাশে মারিয়ার শরীর গুটিয়ে যাচ্ছে অথচ এ দৃশ্য নবীনের ভেতর পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল। কিছু ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কখনো কখনো কিছু মুহূর্তও তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জীবনানন্দে। তখন এক অদ্ভুত ঘোর সৃষ্টি হয়। জেগে ওঠে ভেতরের মৌন, ম্রিয়মাণ সত্তা। অপস্রিয়মাণ সেই আত্মোপলব্ধির সতেজ এক প্রবাহে নড়ে ওঠে জীবন—শীতল পরশে মেতে থাকে কিছু ক্ষণ-সময়-কাল।

নবীন পকেট থেকে স্বর্ণের পায়েল বের করল। এ এক স্বর্গীয় মুহূর্ত মারিয়ার জন্য।

আমার জন্য পায়েল?

নবীনের হাত থেকে স্বর্ণের পায়েল ছোঁ মেরে নিয়ে ভেতর রুমে চলে গেল। নবীন নিজ হাতে পায়েল পরিয়ে দিলে মারিয়া যে লজ্জায় মরেই যাবে আজ। কিছুক্ষণ পর পায়েল পরে নবীনের সামনে এসে দাঁড়াল অপরূপা এক নারী।

আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?

সুন্দর। খুব সুন্দর। তবে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

নবীন মুখে হাসি ধরে রেখে পকেট থেকে একটা আইফোন বের করে মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়া হতভম্ব! বুঝতে পারছে না এ পাওয়াতে ওর কি আনন্দিত হওয়া উচিত নাকি অযথা অপব্যয় করার জন্য নবীনকে কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়া উচিত।

তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছ? আজই এতকিছু আনতে হবে কেন? তুমি চাকরি করছ না, আংকেলের ব্যবসাতেও মন দিচ্ছ না, এত টাকা ব্যয় কি তোমার সাজে?

নবীন নিরুত্তর। মারিয়ার কাছ থেকে এমন বাক্যবাণ ও আশা করে নি। কিছুটা থমথমে পরিবেশ। মারিয়ার ভেতরে কি অপরাধবোধ জেগে উঠল?

তুমি আমার কথায় রাগ করো না প্লিজ। সেদিন দাদু আম্মাকে বলছিল, তুমি কাজ করো না বলে আংকেল তোমার উপর অসন্তুষ্ট। তুমি কিছু না করলে বাবাও হয়তো এ বিয়েতে সম্মতি দিবে না।

একসাথে অনেক কথা বলে ফেলল মারিয়া। আবেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্থিরতা সব কিছু মিলিয়ে ওর ভেতরে এখনই জোর ভালোবাসার তাদিগ জাগছে।

তুমি কিছু ভেবো না। আমি শিগগিরই কিছু না কিছু করব। আসলে আমাদের এত সম্পদ যে তিনপুরুষ বসে খেলেও ফুরাবে না। বাবা অযথাই আমাকে নিয়ে টেনশন করে। আমাদের কে আছে বলো, আমি আর আমার ছোট বোন ছাড়া? বোনটাও তো স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে গেল। হয়তো ওর বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে পাকাপাকি থেকেও যাবে। এত সম্পদ কি বাবা কবরে নিয়ে যাবে?

উনি সম্পত্তি কবরে নিয়ে যাবে নাকি দান করে দিবে সেটা উনার ব্যাপার। আমি যে এই সম্পত্তি ভোগ করব তাতে আমার স্বামীর কতটুকু অবদান থাকবে? তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট থেকে আংকেল আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমি তো লজ্জায় মরে যাব। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে লজ্জায় ফেলতে চাইবে না।

বাইরে থেকে মারিয়ার দাদা রহমত উল্লাহ রুমে প্রবেশ করলেন। নবীন উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। রহমত উল্লাহ’র চেহারায় বিরক্তি। নবীনকে পছন্দ করার মতো কোনো ঘটনা রহমত উল্লাহ’র চোখে পড়েনি আজও। ঘরের ভেতরেও কিরকম গুমোট গন্ধ। রহমত উল্লাহ বুঝতে চেষ্টা করছে একি সিগারেটের গন্ধ? ভেতরের রুমে প্রবেশ করল মুখের বিকৃতি বজায় রেখে। মারিয়া ভয়ে অস্থির। নবীন আতঙ্কিত নয়, বরঞ্চ রাগে ওর শরীর রি রি করছে।

আসরের আজান দিলে মারিয়ার মাথায় ওড়না ওঠে।

লতিফ আহমেদের জানাজায় তুমি থাকবে না?

জরুরি কাজ থাকলে জানাজায় থাকাটা গুরুত্বপূর্র্ণ না।

তোমার আবার জরুরি কাজ কী? যাও যাও জানাজায় অংশ নাও। মুরব্বি মানুষ মারা গেছেন।

বুড়া মানুষ, মরার সময় হইছে মরব না? দেখো না মুয়াজ্জিন সাহেব বলে, একটি সুখ সংবাদ, একটি সুখ সংবাদ।

দুজনই একত্রে হেসে ওঠে।

মারিয়াদের বাড়ি থেকে বের হয়েই নবীন মফিজকে ফোন দেয়, মামা, মনটা খুব ভালো। ছাদে আয়োজন কর। আজ ভরপেট মদ খাব।

দুই. মদের গ্রহণযোগ্যতা নবীনের জন্য এতটাই জীবনমুখী আর প্রেরণাময় যে, বেঁচে থাকার স্বার্থকতা ও প্রতি পেগে পেগে উদযাপন করে। এই স্বাদ ওর জীবনকে নানাভাবে সঙ্গ দিচ্ছে। মন ভালো থাকলে মদে প্রসারিত হয় পৃথিবীর সৌন্দর্য। মন খারাপ থাকলে মদে বন্ধ হয়ে যায় যাবতীয় কষ্টের দরজা। অথচ সেই মদে কোনো নেশা অনুভব করে না নবীন, ওর নেশা শুধু সেলিব্রেশনে। প্রয়োজনে নিজেকে জাগিয়ে রাখা নয়তো আকণ্ঠ ডুবে ভুলে থাকা আপন অস্তিত্ব।

নবীন একটু রাত করেই বাড়িতে ফিরল। মদের ঘোরটা কেটে যাক। বাবা এখন ঘুমিয়ে। নবীনের অজানা নয়, বাবা নিশ্চিত বকাঝকা করবে আজ। গতকাল এক লাখ টাকা নিয়েছে ম্যানেজারের কাছ থেকে। নিজাম তালুকদারের কাছে এক লাখ টাকা হয়তো কিছুই না। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের তুলনায় এ টাকা বালু-কণার মতো। তারপরও কথা থেকে যায়। বালতি বালতি পানি জমিয়ে সাগর রচনা করেছেন, সেই সাগর থেকে বিনা প্রয়োজনে বালতি বালতি পানি সরালে বাবা মানবে কেন? হাসি পেল নবীনের। বেঁচে থাকার জন্য এত আয়োজন, অথচ উদযাপন মৃত ব্যক্তির মতো!

ইমুতে ফোন করেছে সূচনা। একমাত্র সূচনাই ওকে কিছুটা বুঝতে পারে। শত দুঃখের মাঝেও সূচনার সাথে কথা বলা যায়। শত উদ্বেগ সূচনা দূর করে দিতে প্রস্তুত থাকে।

হ্যালো... নিজের কণ্ঠটাই নবীনের কাছে অপরিচিত শোনাল।

হ্যালো, দাদাভাই। আমাকে শুনতে পাচ্ছিস?

শুনতে পাচ্ছি। কেমন আছিস তুই?... নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিল নবীন।

আমি ভালো, দাদাভাই। তোর খবর কী বল।

আমার খবর ভালো। জীবন উপভোগ করছি।

বাহ্, এই তো চাই। অথচ তোর জন্য আমার অনেক টেনশন হয়।

আমাকে নিয়ে টেনশন? বাবা কিছু বলেছে?

বাবার বলতে হবে কেন? আমি জানি না। জীবনটা খেলা নয় রে দাদাভাই। সময় ঠিক প্রতিশোধ নেয়। তখন জীবন অসহায় হয়ে যায়।

বাবা তোকে নিশ্চয়ই ফোন করেছে আজ।

হাসল সূচনা... বাবার সাথে কথা হয়েছে সত্যি। তোর প্রতি অসন্তুষ্টির কথাও জানিয়েছে। বাবার এ উৎকণ্ঠা তো মিথ্যে নয়। গতকালও নাকি এক লাখ টাকা নিয়েছিস। আমি জানি, আমাদের সম্পত্তি অনেক। কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও শেষ হবে না। তারপরও আমার মধ্যে অন্যরকম ভাবনা কাজ করে, একদিন টাকা হয়তো থেকে যাবে, কিন্তু এই আবেগি জোয়ারে তুই না আবার ভেসে যাস।

ভেসে যাওয়ার কিছু নেই। আর ভেসে গেলেও সেখানে ভালোবেসেই যাব।

তবু ভয় হয়।

আমাকে নিয়ে এত ভয় কেন?

বাবা কষ্ট পাবে যে।

বাবা সহজে কষ্ট পায় না। উনি সবাইকে কষ্ট দিতেই অভ্যস্ত।

কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল নবীনের। ঘুম টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ওর সমগ্র অস্তিত্ব। সেই সময়ে শরীর বিকল হলে কল না কেটেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নবীন। সকাল ওকে স্মরণ করাতে পারেনি গতরাতের কথা কিংবা তার মর্মার্থ।

তিন. নবীন কিছুটা অস্থির। ওর জীবনকে বিষাদময় করে দিচ্ছে মৃত্যুর অধিকারে চলে যাওয়া ভাসমান কিছু জীবন। বার্ধক্য, জরা, মৃত্যুতে মিশে থাকা সত্ত্বেও তারা নবীনের জীবনে শ্যেনদৃষ্টি ফেলছে। বাবা হাত খরচের টাকা সীমিত করে দিয়েছে। বেঁচে থাকবে অথচ জীবন উপভোগ করতে হবে মৃতের মতো? জীবনে মৃত্যুময় যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে মারিয়ার দাদা রহমত উল্লাহ আরেক নষ্টের নাম। এ সম্পর্ককে ও কিছুতেই মেনে নিবে না। মারিয়ার বাবার কাছেও সংবাদ পৌঁছেছে। সঙ্গত কারণে মারিয়ার সাথে যোগাযোগে ছন্দপতন হলো নবীনের।

এ পরিস্থিতিতে একটা সিগারেট ভুলিয়ে রাখতে পারে যন্ত্রণাময় অধ্যায়—কিছুটা সময়ের জন্য হলেও। ভেতর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো হতাশা নিয়ে বের হবে আর দূরে সরে যাবে দুরন্ত বাতাসের ঝাপটায়। এরকম উদ্ভট ভাবনায় দুঃখ কমছিল নবীনের। জ্বালিয়েই দিক, পুড়ে যাক যাবতীয় হতাশার স্তূপ।

দুঠোঁটের চাপে সিগারেট যখন আগুনের অপেক্ষায় অস্থির তখনই রহমত উল্লাহ দোকানে এসে হাজির। যেখানে শেয়ালের ভয় সেখানেই কি বেড়া ভেঙে রয়? চোখের পলকে ঠোঁট থেকে সিগারেট হাতে নিল নবীন। বৃদ্ধ রহমত উল্লাহ অভিনয় জানে না, দেখেও না দেখার ভান করতে পারে না, এমনকি সহনশীলও নয়।

নবীনের চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলল, তুমি সিগরেট খাও? আবার হাতে নিয়া দাঁড়ায় আছো?

নবীন বিরক্ত। সব কিছু কি দেখতে হয়? কিছু সুন্দর তো না দেখার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে... আপনি মুরব্বি, সিগারেট তো হাতেই রাখব, নাকি আপনার সামনে ঠোঁটে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ব?

সেদিন আমরার বাড়িতও তুমি সিগরেট খাইছিলা। তুমি পুলা তো বড় বিয়াদব।

নবীন নিরুত্তর। অথচ ভেতরে ভেতরে ও ঠিক উত্তপ্ত হচ্ছে। এখন কথা বললেই গালাগাল দিয়ে বসতে পারে।

রহমত উল্লাহ আবার বলল, নামাজ-কালাম কিছু পড়ো? তুমি মিয়া কী ভাবছ, টাকা হইলেই সব কিছু পাওয়া যায়?

নবীন দোকানদার ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ছেলেটার ঠোঁটে মিটিমিটি হাসির চাষ। একটু পরেই যেন হাসির পূর্ণ আয়োজনে ফসল ফলবে। এ বড় লজ্জার ব্যাপার। মারিয়ার আপন দাদা হলেও তো এ শাসন মানতে পারত না নবীন। আর এ তো বাবার চাচা।

দশ বছর আগেও তো আপনাকে নামাজ পড়তে দেখি নাই। আমিও না-হয় আপনার মতো বুড়া হয়ে নামাজ পড়ব। নামাজ পড়ার সময় তো অনেক পড়ে আছে। যৌবনে নামাজ না পড়লেও চলে।

তুই কি নাস্তিক? জাহান্নামে যাবি তো!

নবীনের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তুই শব্দটা ওর কানকে অপ্রস্তুত করে না বহু বছর। অথচ এই বুড়া বলে কী! যার এক পা কবরে চলে গেছে। দুই পা কবরে গেলেই মুয়াজ্জিন সাহেব ‘সুখ সংবাদ, সুখ সংবাদ’ বলে সুরে সুরে গান গেয়ে উঠবে। এর কিনা এত তেজ! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না নবীন।

এর জন্যই পোলাপান বলে, বুড়াগুলান মাইনষের চোদা না।

রহমত উল্লাহর কাছে এ উত্তর অপ্রত্যাশিত। অবাক হলো। হতভম্ব... তোমার বাপও তো বুড়া। তোমার বাপরে এই প্রশ্নটা আমি জিজ্ঞাস করুম। বুড়া মানুষ তাইলে কার... কথা শেষ করতে পারল না রহমত।

আবার তুমিতে চলে আসছে বলে নবীনের রাগ কমল না। মুখে সিগারেট গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এসে আগুন জ্বালাল। ধোয়ার কুণ্ডলী ছাড়তে ছাড়তে অদৃশ্য হয়ে যাবার মুহূর্তে মফিজকে ফোন করল।

মামা, মেজাজ খুব খারাপ। ছাদে আয়োজন কর। আজ ভরপেট মদ খাব।

চার. মদ না থাকলে পানসে আর নিরানন্দ হয়ে যেত নবীনের জীবন। মারিয়ার মুগ্ধতা নবীনকে যেমন বাঁচার প্রেরণা জাগায়, রহমত উল্লাহর অযাচিত আক্রমণ তেমনি দূরে সরিয়ে দেয় জীবনের সৌন্দর্য থেকে। এই আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখসহ যাবতীয় বৈপরীত্য এক সুতোয় বাঁধতে পারে মদ। অপার্থিব এক পাঠ হয়ে যায় কোমল তরলে।

রাত বড় হলে দিন ছোট হয়। ঘুমেই চলে যায় সকালের নরম আর সজীব অধ্যায়। নবীনও ঘুমে বিভোর। ফোন বেজে উঠল নবীনের কানে। একবার। দুইবার। তিনবারের সময় দেখল অপরিচিত নাম্বার। নবীন বিরক্ত।

হ্যালো!

এই, এত সকাল পর্যন্ত ঘুম? কতবার ফোন করতে হয় তোমাকে?

নবীন নড়ে উঠল। মারিয়া! জীবন আসলেই সুন্দর... এটা কার নাম্বার? তুমি ফোন করবে জানালে আমি এক ঘণ্টা আগেই উঠে পড়তাম।

থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না। এটা আম্মুর নাম্বার। ফতুল্লা রেল স্টেশনে আজ বিকেল পাঁচটায় আসতে পারবে? তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।

আসতে পারব না মানে? অবশ্যই পারব। জরুরি কী কথা?

আগে স্টেশনে আসো তারপর বলব। রাখছি।

দুম করে কলটা কেটে দিল। এভাবে কি কল কেটে দিতে হয়? মেয়েটা কি বুঝতে পারে না, এই মুহূর্তগুলো কতটা দ্রুত জীবনকে মৃত্যুতে নামিয়ে দেয়। কী কথা বলবে মারিয়া? হাজারো প্রশ্নের ভাবনায়, উৎকণ্ঠায় কিভাবে সময় কাটবে! সময় তো এখন কাছিমের পিঠে ভর দিয়ে হাঁটবে নিশ্চিত। রহমত উল্লাহ বাড়ি গিয়ে কী বলেছে কে জানে। মৃতদের অধিকারে সময় চলে গেলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। আবার ঘুমিয়ে পড়া যাক। ঘুমই হয়তো সময়কে দ্রুত নিয়ে যাবে মারিয়ার কাছে। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় অনেকটা সময় কাটিয়ে দিল নবীন। এপাশ-ওপাশ চলছে নিয়মিত। ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল দশ মিনিটও অতিক্রান্ত হয়নি। মাথার ভেতর যন্ত্রণা শুরু হলো। কয়েকটা সিগারেট সত্বর শেষ করতে না পারলে অস্থিরতা, অভিঘাত ওর শরীরকে নিমেষেই অসুস্থ করে তুলবে। প্রাণের খেলায় চলল সিগারেটের পর সিগারেট পান। অতঃপর বাথটাবের ঠান্ডা জলে দীর্ঘক্ষণ স্নাত হওয়া। নাস্তা খেয়ে বের হলো চায়ের দোকানের উদ্দেশে। এক কাপ রং চা রঙিন জীবনকে আরেকটু চাঙা আর উদ্যমী করে তুলুক না।

প্লাটফর্মে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মারিয়া আসবে অথচ এ মুহূর্তটাকে ওরা কোলাহলমুক্ত রাখতে পারল না। এক মারিয়াতেই মুখর হতে পারত নবীনের কাঙ্ক্ষিত এ সময়টা। চিৎকার, চেঁচামেচি, হই-হুল্লোড় চলছে ট্রেনের প্রতীক্ষায়। ট্রেন চলে আসুক। থেমে যাক মানুষের সরব উপস্থিতি। শুধুমাত্র এক মারিয়াময় হয়ে উঠুকনা স্টেশন-ভুবন।

ট্রেন চলে এল। মানুষের মাঝে বিরামহীন চাঞ্চল্য। অস্থির পদচারণা। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন থামল। ভেতরের যাত্রীদের নামার আগেই ভেতরে প্রবেশ করতে চায় বাইরের যাত্রীদের একাংশ। ধাক্কাধাক্কি, গালাগালি চলছে—নবীন দেখছে নিয়মিত অনিয়মের চিত্র। যাত্রী বোঝাই ট্রেন চলে যাচ্ছে। স্টেশন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে গভীর নিস্তব্ধতার ভেতর। ট্রেনহীন স্টেশন এখন জনশূন্য। পাঁচটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। নবীন সময়ের বেশ কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছে। মারিয়া আসছে, স্টেশনটা ওদের প্রেমের জন্য ঐতিহাসিক হয়ে যাবে কি? নীল সালোয়ার কামিজ, ওড়নাও নীল—বেদনার রং নিয়ে অবগুণ্ঠিত কেন এই রমণী! তবে কি সম্পর্ক-রহিত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছে?

মারিয়ার বাঁ পায়ে চোখ রাখল নবীন। পায়েল তো পায়েতে মিশে নাচতে নাচতেই এগিয়ে আসছে। মুখও বলছে উচ্ছ্বাসের গল্প। চোখের গভীরে যেয়ে নবীন খুঁজছে ভালোবাসার পথ—মসৃণ হোক, হোক মায়াময়। রহমত উল্লাহ যাই করুক, নবীন এই নারীকে হারাতে পারবে না এক জীবনে।

কাছে এল মারিয়া, অথচ কিছুটা দূরত্ব। হাসল। প্রাণোচ্ছল। প্রেমময়। নবীন কাছে গেল। ঘনিষ্ঠ হতে চাইল। ঘ্রাণ পাচ্ছে এখন ভালোবাসার।

কেমন আছো? জরুরি তলব?

আমি ভালো আছি। তোমাকে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগছে... মারিয়া বেশ সপ্রতিভ।

কী বলছ এসব? এ কথা তো আমার বলা উচিত তোমাকে।

নবীনের এ পাওয়া অপ্রত্যাশিত। এরকম অযাচিত মুহূর্ত কখনো কখনো লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চায়ের কথা বলল নবীন। ট্রেন স্টেশনে সাত্তার ভাইর দোকানের চা না হলে আড্ডা একেবারেই জমতে চায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে ভালোই লাগছে। আলাদা মজা। নবীন এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য। ভেতরের যাবতীয় উদ্বেগ উড়ন্ত ধোঁয়ার মতো চলে যাচ্ছে।

তুমি দাদুকে কী বলেছ?... আচমকাই শুরু করল মারিয়া।

উনি বাড়িতে যেয়ে কী বলেছেন?

উনি তো খোলাসা করে কিছু বলছেন না। মায়ের কাছে বলেছে তুমি নাকি উনার জন্ম নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছ।

নবীন হাসছে। বেচারা প্রকাশ করতে পারেনি। বুড়া মানুষ নিয়ে এই এক সমস্যা।

আরে বাবা, হাসছ কেন? আমি কি হাসির কিছু বললাম? দাদু হয়তো বাবাকেও বিষয়টা জানাবে।

নবীন হাসি থামাল... আমি আসলে উনার জন্ম নিয়ে কিছু বলিনি। বুড়া মানুষের জন্ম নিয়ে বলছি।

মানে কী?... মারিয়ার চোখে-মুখে কৌতূহল।

খালাম্মা কিছু মনে করেছে কিনা তাই বলো।

আম্মা দাদাকে চেনেন। উনি কিছু মনে করেননি। কিন্তু বাবা যদি কিছু মনে করেন? বাবা তো চাচা অন্তপ্রাণ।

আসলে কী জানো, বুড়া বুড়া মানুষগুলা সময়ের চেয়ে বেশি বেঁচে পৃথিবীটাকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে ফেলছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর বুড়া মানুষের বেঁচে থাকা ঠিক না।

যাও, কী যে বলো না তুমি। দাদার সাথে দেখা করে সরি বলে নিও। মুরব্বি মানুষ, খুব বেশি দিন তো আর সত্যিই বাঁচবে না।

মারিয়ার ‘যাও’ বলার পর আর কিছু শোনেনি নবীন। ‘যাও’ বলার মাঝেও মেয়েটার কী অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিমা। অপাঙ্গে চেয়ে দেখল নবীন। মারিয়াকে কাছে পেতে মন চাইল, একান্তে। স্পর্শের সুখ পেতে ব্যাকুল ওর দুরন্ত আঙুলগুলো। কবে আসবে এ মেয়ে জীবনের ভেতর স্বর্গ রচনা করতে।

মারিয়া, তুমি আমাকে ভালোবাসো তো? যাবে না তো আমায় ছেড়ে কোনোদিন?

মারিয়া হাত ধরল। কে দেখল আর কে দেখল না এসব ভাবনা এখন অর্থহীন। প্রেম বোধহয় এমনই। সাহসী করে তোলে।

তোমাকে দিনে দিনে অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলছি। সবসময় তোমার পাশে থাকব। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না যেন।

নবীনকে আনন্দে ভাসিয়ে মারিয়ার বিদায়। পৃথিবী এক স্বর্গ, যদি প্রেম থাকে জীবনে। নবীন মফিজকে কল দিল, মামা, মনটা খুব ভালো। ছাদে আয়োজন কর। আজ ভরপেট মদ খাব।

পাঁচ. রাত নয়টার দিকে বাড়ির পথে নবীন। উদ্দেশ্য, ভাত খেয়েই মফিজের আয়োজনে যোগ দেবে।

আজ মনটা বেশ ঝরঝরে। জীবন যেন কবিতার মতো ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলছে—অন্ত্যমিলও চমৎকার। বিমুগ্ধকর। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই নবীনের চোখ কপালে। রহমত উল্লাহ বের হচ্ছে বাড়ি থেকে। চেহারায় অসন্তুষ্টির প্রকাশ স্পষ্ট। কিছুটা উন্নাসিক ভাব শরীরে। বাবার কাছে নিশ্চিত নালিশ নিয়ে এসেছিল। পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণে আছে? ভাবনা গভীর থেকে গভীরে চলে যায়। নবীন লক্ষ করছে, গতির স্বাভাবিকতা অক্ষুণ্ন রেখে চলছে না ওর পা। গতকালের পাপ কি গুরুতর ছিল? শরীর অবশ আর বোধহীন হয়ে যাচ্ছে কেন?
বুড়া মানুষ মাইনষের চোদা না। এ কথা কেন বললে?... বাবা যদি জিগ্যেস করেই ফেলে এর উত্তরে কী বলবে নবীন? বুড়া রহমত উল্লাহ একটা পিছ। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে রাগ, ক্ষোভ, হিংসাকে বিশেষ বিশেষ সময়ে দমিয়ে রাখতে হয়। এতটা বয়স পরেও কতকিছু অজানা রয়ে গেল এই বৃদ্ধ-শিশুটার!

রুমের ভেতর প্রবেশ মুহূর্তে বাবার ডাক। নবীন রুমের সীমানা থেকে বের হলো। জড়োসড়ো পায়ে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়াল।

কাল রহমত উল্লাহকে কী কইছোত?...ভূমিকা ছাড়া শুরু করলেন নিজাম তালুকদার।
নবীন নিরুত্তর।
এবার পূর্ণ রাগের প্রকাশ...আমিও তো বুড়া। কাল তো তুই আমারে কইবি।

রহমত উল্লাহ আগে আমাকে বাজে কথা বলছে।

বাজে কথা কয় নাই। তোরে নাস্তিক কইছে। তুই কি নাস্তিক না? নামাজ পড়োছ, রোজা রাখোছ?

কিছু মনে করবেন না। আপনিও খুব বেশিদিন হয় নামাজ ধরেন নাই। নবীন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।

ছেলের এরকম বেয়াদবি অপ্রত্যাশিত। রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নিজাম তালুকদার... ফাজিল, মুখে যা আসে তাই কয়। আল্লাহ আমারে হেদায়েত করছে। তোর মতো শয়তানের এ ভাইগ্য আছে বইলা মনে হয় না।

চুল পাকুক। আমিও নামাজ পড়ব। আল্লাহর মন চাইলে আমাকে হেদায়েত করবে। এখন ঘুমাতে যান।... নবীন হনহন করে ঘরের ভেতর চলে গেল।

হতভম্ব নিজাম তালুকদার। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। অতঃপর শুরু হলো নবীনের উপর কটুবাক্যবর্ষণ।

এই রকম কুলাঙ্গাররে ত্যাজ্য করা দরকার। আমার সম্পত্তির এক কড়িও অবাইধ্য পুলার লাইগা না। এই বয়সে আমার কেন নালিশ শোনা লাগব? লাত্থি দিয়া ঘর থেইকা বাইর কইরা দিলে ভিক্ষে করা ছাড়া উপায় আছে?

এরকম কটুবাক্য যখন চলতেই থাকল তখন আচমকাই অনিয়ন্ত্রিত রাগ প্রকাশ করে ফেলল নবীন। ফুলদানি হাতে নিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল আয়নায়। চেয়ে দেখল, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে ওর মুখ-মণ্ডল।

ভাত না খেয়েই বের হলো। মদের আয়োজন তো পূর্ব নির্ধারিত। মফিজকে সব খুলে বলার পর ও রাম, ওয়াইন, হুইস্কি নিয়ে আসর বসাল ছাদে। পেগের পর পেগ মারতে মারতে চূড়ান্ত মাতালে পরিণত হলো দু’জন।
নবীন বলল, আজ যদি রহমত বুড়া মারা যায়?

মফিজ বলল, একটি সুখ সংবাদ।

আজ যদি নিজাম বুড়া মারা যায়?

একটি সুখ সংবাদ।

যদি দুইজন একসাথে মারা যায়?

দুইটি সুখ সংবাদ।

অট্টহাসিতে মেতে ওঠে দু’বন্ধু। হাসতে হাসতে বেহুঁশ মফিজ ছাদে শুয়ে পড়ে অচেতন। এদিকে নবীন নতুন বোতলের ছিপি খোলে। গ্লাসে ঢেলে নেয় তরল কিছু দুঃখ। জল মেশানোর প্রয়োজন বোধ করে না। চলতে থাকে পেগের পর পেগ।

নবীন বোতল হাতে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। দূরে দেখে বিচূর্ণ আয়নায় ক্ষত-বিক্ষত মুখ। আয়নাতে পরিচিত কিছু মানুষ। সূচনা আর মারিয়াকে ডাকে, অথচ ওরা দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। চোখের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে প্রতি পলকে পলকে। ওরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে, লীন হয়ে যাচ্ছে। মফিজ এখনও অচেতন। নবীন সজোর ধাক্কায় ওকে তুলতে চাইল। অথচ ঘুম এক শান্তির ঠিকানা। ঘুমাক ব্যাটা। নবীন হাসল। সূচনা আর মারিয়ার কাছে যাবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা নবীনের। ওরা ছাড়া আর কে ভালোবেসেছে ওকে।

আরো দূরে মায়ের মুখ—অস্পষ্ট, অথচ মায়াময়। এ মায়া স্পর্শ করা দরকার। ছাদের উপরেই পড়ে গেল। আবার উঠে দাঁড়াল। চোখ ক্রমশ ঘুমের দখলে চলে যাচ্ছে, তবে পা বিরামহীন। ছাদের শেষ প্রান্তে চলে যাচ্ছে ও। শরীর বোধহীন—অনন্ত এক শূন্যতায় নিজেকে ফেলে দিচ্ছে নবীন। ক্রমশ পালিয়ে যাচ্ছে জীবন। অন্ধকার অন্ধকার এবং অন্ধকার।

একটি সুখ সংবাদ! একটি সুখ সংবাদ! জোড়পুল নিবাসী মো. নিজাম তালুকদারের ছেলে নবীন তালুকদার মদ্যপ অবস্থায় রহস্যজনকভাবে ছাদ থেকে পড়ে গতকাল রাত আনুমানিক বারো ঘটিকায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিওন। মৃত্যুকালে তাহার বয়স হইয়াছিল তিরিশ বৎসর। মরহুমের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হইবে বাদ জোহর জোড়পুল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে। আপনারা দলে দলে যোগদান করিয়া মরহুমের মাগফেরাত কামনা করুন। একটি সুখ সংবাদ, একটি সুখ সংবাদ... 

এসএস