Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বাংলা ভাষার শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ

অ্যাডভোকেট রোকনুজ্জামান খান

মে ২৯, ২০২০, ০১:১৫ পিএম


বাংলা ভাষার শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ

প্রত্যেক জাতিরই একটা নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। নর তত্ত্ব জাতিতত্ত্ব ও ভাষাতত্তের অতি যৌগিক ক্রিয়া কর্মের মাধ্যমে সেই জাতির ভাষার পরিস্ফুটন ও বিকাশ ঘটে। বাংলা ভাষার মূল আলোচনার আগে আমাদেরকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভৌগোলিক ভূখন্ড, জাতিতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও রাস্ট্রীয় জনপদ নিয়ে আলোকপাত করা আবশ্যক।

আজ বাঙ্গালী নামক যে জাতি বাংলাদেশ নামক দেশটির এই জনপদে বাস করে পুর্বে তার নাম বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। মহাভারতে ঐতরেও আরন্যক বালকান্ড অধ্যায়ে সর্ব প্রথম বঙ্গ জনপদের নাম পাওয়া যায়।

মহাভারতের সৃষ্টি প্রায় ৫০০০ বছরে পূর্বে। ব্যাদব্যাস কর্তৃক রচিত সর্ব প্রাচীন এই গ্রন্থে বঙ্গ শব্দটি প্রথম আবিস্কৃত। উল্লেখ আছে যে আর্য দেবতা দীর্ঘতমা ঋষির চারিত্রিক লাম্পট্যের কারণে তাকে আর্যরা একটি ভেলায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। তখন হিমালয়ের পাদ দেশে টিসিস নাম করে একটা সাগর ছিল। ভেলাটি ভাসতে ভাসতে দ্রাবিড়ের মহারাজা বলির ঘাটে এসে বেঁধে যায়। প্রাতস্নান করার জন্য মহারাজা বলি যখন নদীর ঘাটে আসেন তখন তিনি ভেলায় ভাসা ঐ সুদর্শন আর্য ঋষি কে দেখতে পান এবং তিনি তাকে বাড়ি নিয়ে যান।

আর্য ঋষি দীর্ঘতমা ছিল অন্ধ। মহারজা বলির কোন সন্তান ছিল না। তার স্ত্রীর নাম ছিল সুদেষ্ণা। তখন আর্য মুনি ঋষি দের দিয়ে অনার্য স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা ছিল বৈধ ও ধর্মীয় সামাজিক রীতি সিদ্ধ। ফলে রাণী সুদেষ্ণার গর্ভে আর্য ঋষি দীর্ঘতমার ঔরসে ৫টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

তাদের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, সুস্ম, কলিঙ্গ ও পুন্ড্র। তাদের ৫ ভাইকে মহারাজ বলি ৫টি অঞ্চল রাজত্ব করতে দেন এবং তারা সন্তান জন্মদিয়ে জনবসতি গড়ে তোলেন। এদিকে বলির পুত্র বঙ্গ পেলেন আমাদের আজকের এই জনপদের রাজত্ব। এই বঙ জনপদের অধিবাসীদের বাং বলা হতো।

অপর দিকে পবিত্র কোরআনে সুরা নুহ নামে একটি সুরা নাজেল হয় সেখানে উল্লেখ করা হয় যে মুনুষ্যকুল বিপদগামী হলে মহান রাব্বুল আলামিন মহা প্লাবনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতি একজোড়া করে পশু পাখি জীব জানোয়ার নিয়ে নূহ (আঃ) এর কিস্তিতে ওঠেন। পরে মহাপ্লাবনে পৃথিবী ধ্বংস হয়।

বাইবেলের old testament-এ একই কথা বলা আছে। নূহ নবীর তিন পুত্র ছিল। তাদের নাম সাম, হাম এবং ইয়াফেজ। এই হামের এক পুত্র ছিল বং। সেই বং-ই এই জনপদের মানুষকে হেদায়েতের দ্বায়িত্ব পান। তার নামানুসারে এই বং জনপদ।

অপর দিকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক-এর মতে বং শব্দটি চীন দেশ থেকে এসেছে। উদাহরণ স্বরুপ বং এর অং শব্দ এবং গঙ্গা শব্দটির সাথে হোয়াংহো এবং ইয়াংসিকিয়াং নদীর মিল আছে। সুতরাং এই বং শব্দটি কোথা থেকে এসেছে তা ঐতিহাসিকভাবে নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নাই।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ অব্দে মহামতি আলেকজান্ডার বিশ্ব বিজয় করলেও তিনি মগধ রাজ্য জয় করতে পারেন নাই। এই মগধ রাজ্যই হচ্ছে বং বা বঙ। আইন-ই আকবর-ই গ্রন্থের প্রণেতা ঐতিহাসিক আবুল ফজলের মতে জনপদটি সাগর পাড়ে হওয়ায় এখানকার অধীবাসীরা জ্বল্লোচ্ছাস ও প্লাবন ঠেকাতে তারা ২০/৩০ গজ উঁচু আইল নির্মাণ করতেন।

আর এই বং শব্দটির সাথে আইল প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বং+ আইল= বংগাইল< শব্দটি হয়ে যায় বাঙ্গাল। যেমন ডাক+আইত = ডাকাইত> বা ডাকাত। পরবর্তীতে বাঙাল শব্দের সাথে ষ্ণিক প্রত্যয় যুক্ত হয়ে শব্দটি হয়ে যায় বাঙ্গালী। নামকরনে বঙ্গ শব্দটি কালের পরিক্রমায় পাল ও সেন আমলের বঙ্গ, সুলতানি আমলের শাহী বাঙ্গালা, মুঘল আমলের সুবে বাঙ্গালাহ, ইংরেজ আমলের বেঙ্গল, পাকিস্তান আমালের পূর্ব পাকিস্তান অতঃপর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পবিত্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই বাংলাদেশ।

এই জনপদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হয়েছে। এখানে নিরাদ, কিষাদ, আলপাইন, ককেশীয়, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় ও অদ্রাবিড়, আর্য অনার্য, ইউরোপেড, নিগ্রোয়েড প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর রক্তের কৌমজ স্রোতধারায় হাজার বছরের স্বজাতি আর বিজাতীর মিলন বিরহে বঙ জনপদে যে জাতি বাস করে আজ তারাই হচ্ছি এই বাঙ্গালী জাতি।

শংকর জাতি হিসেবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে নিয়ে আসা ভাষাই বাংলা ভাষাকে সম্বৃদ্ধশালী করেছে। এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃত ভাষায় মূল সংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন হয়ে তৎসম অর্ধ তৎসম তদ্ভব এবং খাটি বাংলার সাথে বিদেশি শব্দের যোগফলে রহস্যেঘেরা এক আমোদে ভাষাই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা।

বাংলা ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডারের অতি সামান্যই ডিকশনারিতে স্থান পেয়েছে আর সবই রয়েছে লোকমুখে। রুপ রসে টইটম্বুর অথচ দারুন জটিল এই ভাষার রস আস্বাদন করাটা অত সহজ কাজ নয়। তারই কিছু শব্দ নিয়ে আজকে আমাদের আলোচনা।

১. বেয়াড়া শব্দ: বাংলা ভাষায় ২টি বেয়াড়া শব্দ আছে যা ব্যকারণের সকল নিয়ম নীতি ভংগ করে মহা দাপটের সাথে দীর্ঘ দিন যাবৎ রাজত্ব করে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহ তাদের পরিবর্তন তো দূরের কথা এই শব্দ ২টির গায়ে আঁচড় পর্যন্ত লাগাতে পারে নাই। একটি হলো বেদানা। যার অর্থ দানা নাই অথচ জগতের সকল দানা যেন বেদানার মধ্যেই সৃষ্টি কর্তা দিয়ে রেখেছেন।

আর অন্যটি হলো আনারস যার অর্থ হলো আনা মানে নাই আর রস অর্থ রস বা জুস। অর্থাৎ রস নাই। এখানেও জগতের সকল রসই যেন এই আনারসে ভরে টুইটুম্বুর। সুতরাং আনারস আর বেদানার টিকিটা কে ধরবে?

২. রান্নাঘর থেকে পাওয়া যে শব্দ: তেলে বেগুন- তেল ও বেগুন সমাস বদ্ধ হয়ে শব্দটি হয়েছে তেলেবেগুনে।কিন্ত এর আভিধানিক অর্থের সাথে শব্দ ২টির নিজস্ব অর্থের কোনই মিল নাই। কেননা তেলে বেগুনের অর্থ হচ্ছে হটাৎ ক্রোধানিত হওয়া। তো তেল আর বেগুনের সাথে এ-র কি সম্পর্ক আছে।

এখন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে শব্দটি সরাসরি রান্নাঘর থেকে বাংলা ডিকশনারিতে স্থান পেয়েছে। ধারণা করা হয় যে, বেগুন চাকা চাকা করে কেটে করাইতে গরম তেলের উপর ছেড়ে দিলে যেমন বিস্ফোরণ উন্মুখ পরিস্থিতি হয়। ফলে হটাৎ অগ্নিশর্মা হওয়া যেন ওই উপমারই ফলশ্রুতি শব্দএই ‘‘তেলে বেগুন’’।

৩. কাকতালীয় :  বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে  যা উল্টো দিক দিয়ে সাজালেও একই অর্থ দাঁড়ায়। যেমন-  ‘‘র  মা  কা  ন্ত  কা  মা  র’’। ইংরেজিতে অনুরুপ মাত্র ২ টি word আছে। madam, reviver.

৪. শব্দযোগ: এতো গেল বর্ণমালার খেলা এবার দেখবো শব্দের খেলা।জীবন আনন্দ দাসের কবিতা থেকে এই বাক্যটি নিলাম। ‘‘আবার আসিব ফিরে’’। এবার বাক্যের শব্দগুলি উল্টাবো। উল্টালে কি দাঁড়ায় ‘‘ফিরে আসিব আবার’’। এখানে দুটি বাক্যই সঠিক। যদিও কবি জীবনানন্দ দাস সাধুভাষা আর চলিত ভাষার বিভাজনে কোনো ধার ধারতেন না। তার লেখা এই বাক্যের ভুল ধরা হয়তো আমার আদৌ সমীচীন নহে তথাপি আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের কারণে আমাকে বলতে হচ্ছে যে তার ঐ বাক্যে তিনি দুইটি শব্দ সাধু ভাষায় লিখেছেন আর একটি লিখেছেন চলিত ভাষায়। ‘‘আবার আসিব’’ শব্দ দুটি সাধু রীতি আর ‘‘ফিরে’’ শব্দটি চলিত রীতিতে।

ব্যকরণ এর নিয়ম মানলে ফিরে শব্দটি হওয়ার দরকার ছিল ফিরিয়া। ফলে আমরা বাক্যটি উল্টিয়ে লিখলে হয়- ‘‘ফিরিয়া আসিব আবার’’। সুতরাং এটাই একটি পরিশুদ্ধ বাক্য।

৫. সিংহভাগ: ‘‘সিংহভাগ’’ এই শব্দটির অর্থ সাধারণত বেশির ভাগ। যেমন এবারের বাজেটের অর্থের সিংহ ভাগই দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে। কিন্ত শব্দটির উৎপত্তি ছিল এক রসের কান্ড। একদা সুন্দরবনে একটি সিংহ আর একটি শিয়াল দুজনে মিলে একটি হরিণ শিকার করলো। এখন ভাগ করার পালা। যথারীতি সিংহ মামাই মাংস ভাগ করতে লাগলো। সিংহ শিয়াল কে আশ্বস্ত করলো মামা তুমি কোন চিন্তা করে না আমি একে বারে ন্যায্য ভাগ করবো। এই বলে সিংহটি পাতার উপর মাংস গুলো তিনটি ভাগে ভাগ করতেছিল।

তখন শিয়াল বাঘকে বললো মামা তিন ভাগ কেন।আমরা তো দুজন শিকার করেছি। মাংস দুইভাগ হবে। তখন সিংহ গর্জে উঠে বললো আমি হলাম বনের রাজা। আমার রাজ ভাগ যাবে কোথায়। এই ধরো রাজভাগ বাদ দিয়ে আর যা রইল এখন তুমি অর্ধেক আর আমি অর্ধেক। শিয়াল মামা ভয়ে কোন প্রতিবাদ করল না। ফলে ভাগ হয়ে গেল তিনটি। সিংহ নিলেন দুইভাগ আর শিয়াল পেল এক ভাগ। সেই থেকেই কাঠুরিয়া দের মাধ্যমে শব্দটি সরাসরি সুন্দরবন বন থেকে লোকালয়ে চলে এসে বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়লো আর স্থান পেল শব্দ টি বাংলা ডিকশনারি তে -‘‘সিংহভাগ’’।

৬. দেবতার অন্ডকোষ: বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মানে পৃথিবী কিন্তু সন্ধি বিচ্ছেদ করলে মানে দাঁড়ায় বিশ্ব মানে সমগ্র আর ব্রহ্মান্ড ব্রহ্ম+ অন্ড = ব্রহ্মান্ড অর্থাৎ হিন্দু দেবতা ব্রহ্ম দেবের অন্ডকোষ। তাই এই পৃথিবীকে ব্রহ্মদেবের বা ব্রহ্মের অন্ডকোষ হিসাবে লিখলেও তাতে কোন ভুল নাই।

৭. কীর্তনযোগ: পদাবলী কীর্ত্তনে ‘‘গৌর আমায় দোষে ফেলেছো’’ এই বাক্য টা যদি উল্টিয়ে এভাবে দেই ‘‘গৌর আমায় ফেলেছো দোষে’’।এখানে দুটি বাক্যই সঠিক এবং সাবলীল কিন্ত তা হলে হবে কি, বাক্য দুটি সঠিক হলেও অর্থের দিক দিয়ে আমার তৈরি বাক্যটি মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে। যেমন বিপদ জনক এই দুটি শব্দ দ্রত উচ্চারণ কালে দুটি শব্দের প্রথম শব্দটির ‘দ’ শব্দটি অনুচ্চারিত হয়ে উচ্চারণ হচ্ছে বিপজ্জনক। এমনিভাবে পরের বাক্যটি কাব্যিক ভাষায় দ্রুত উচ্চারণ কালে বাক্যটির ‘ছ’ এর স্থলে ‘চ’ উচ্চারিত হয়ে দাঁড়াবে ‘‘গৌর আমায় ফেলেচোদোষে’’ যা অশ্লীল।

৮. কাছারি থেকে পাওয়া: কোন বই পুস্তকে পাই নাই তবে আমাদের পাশের গ্রাম সিন্দাইনের ইন্তাজ মাতবরের কাছারি থেকে পেয়েছি একটা উপপ্রবাদ। ‘‘বা--- বা---- জোড়া দিয়ে বর্ধমান যাওয়া যায় না’’। বাক্যটি ঈষৎ অশ্লীল হলেও বাক্যটির মর্মার্থ কিন্তু যথার্থ।

৯. অপ্রত্যুৎপন্নমতিতা: বাসা ভাড়ার সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে বাড়ির মালিক এক ভদ্র মহিলা নিজ তলায় চেয়ারে বসে মোবাইলে গেম খেলছেন। এমন সময় ২৫ বছরের এক ছাত্র বাড়ি ভাড়ার সাইনবোর্ড দেখে ম্যাডামকে গিয়ে বললেন ‘‘ম্যাডাম ভাল বাসা হবে’’। শব্দটি শুনে ম্যাডামের মাথায় যেন বাঁজ পড়লো। ম্যাডামতো রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে স্যান্ডেল
খুলে আচ্ছা মত পেটালেন ছেলেটাকে এবং বলতে লাগলেন ‘‘তুই আমার পুলার বয়সের ছেলে হয়ে আমার কাছে ভালবাসা চাস? আমার স্বামী নাই?’’ এটা ছিল একটা নিছক ভাষার ভুলের ভুলবুঝাবুঝি। ভালবাসা আর ভাল বাসা উচ্চারণকালে পৃথক করার কি কোনো সুযোগ ছিল এই হতভাগ্য ছেলেটির ?

১০. গুলিয়ে ফেলা থেকে বাঁচুন: কিলোমিটারে হেক্টমিটার সেন্টিমিটার এ গুলিয়ে যাবেই। তা হলে এবার এই বাক্যটি মনে রাখুন- কিলাইয়া হাকাইয়া ডাকাত মারিলে দেশের শান্তি মিলিবে। কিলাইয়া-মানে কিলোমিটার, হাকাইয়া- হেক্টমিটার, ডাকাত- ডেকোমিটার, মারিলে- মিটার, দেশের- ডেসিমিটার, শান্তি - সেন্টিমিটার, মিলিবে- মিলি মিটার।

১১. পরম্পরা: মুঘল বাদশাদের বংশ পরম্পরা মনে রাখা ভীষণ দ্বায়, গুলিয়ে যাবেই। মনে রাখুন ‘‘বাবার হইল একবার জ্বর সারিল ঔষধে’’। এখানে বাবার মানে- বাবর, হইল মানে-- হুমায়ুন, একবার মানে- আকবর, জ্বর মানে- জাহাঙ্গীর, সারিল মানে- সাজাহান, ঔষধে মানে ঔরংজেব।

১২. হাফ বাঙ্গালী: একজন হিন্দি ভাষাভাষী কিছুদিন হলো কলকাতায় এসেছেন। আস্তে আস্তে কিছু ভাংগা ভাংগা বাংলা ও শিখেছেন। তিনি কলকাতা শহরের একটি ফ্যক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন- ‘‘হরে কর কমবা জিওবা রুদে রকা রখানা ডড নংক লিকাতা‘’। আসলে লোকটা এই শব্দের অক্ষর পরের শব্দের অক্ষরের সাথে মিলাচ্ছিলেন। তা দেখে কলকাতার কিছু বাবুরা মুখ টিপে হাসতে ছিল কারণ বেচারির একটা শব্দ ও সঠিকভাবে উচ্চারিত হয়নি। আসলে বাক্যটি ছিল ‘‘হরেক রকম বাজি ও বারুদের কারখানা ৬৬ নং কলিকাতা’’। পাগল শুধু বাংলাদেশেই নাই কলিকাতায়ও আছে।

১৩. বৈশ্য <বেশ্যা: আধ্যাত্মিক জগতের প্রধান প্রবাদ পুরুষ ও বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ। তিনি তার জীবদ্দশায় প্রায় ৪ হাজারের উপরে দেহত্বত্ত, সৃষ্টি তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, কোরান, হাদিস, শরিয়ত, মারফত নিয়ে গান লিখেছেন। তিনি তার একটি গানে এভাবে লিখলেন- ‘‘জাত গেলাে জাত গেলো বলে, একি আজব কারখানা/সত্য পথে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তানা নানা। /গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয় এ-ই ভ্রম তো গেল নারে''।

সাঁইজি এখানে বেশ্যাকে মহত্মের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করেছেন। সাঁইজি বুঝাতে চেয়েছেন বেশ্যার বাড়িতে কেউ গোপনে ভাত খেলে তাতে ধর্মের কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ ভাত অপবিত্র নয়। বেশ্যারাই মানুষকে ভজনা করে। ভালোবেসে ভাত ও জাত দেয়। বেশ্যা শব্দটি প্রায় ৪৫০ বছর পুর্বে বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। হিন্দুদের আদিগ্রন্থ ঋকবেদে ‘‘বৈশ্য’’ শব্দটির উল্লেখ আছে। বেদে জাতপাতের বিবেচনায় ৪ শ্রেণি-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। ব্রাহ্মণরা বেদের প্রচার করবে, ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধ করবে, বৈশ্যরা ব্যাবসা করবে আর শুদ্ররা কৃষি কাজ করবে। মুল সংস্কৃত ভাষায় বৈশ্য শব্দের মুল অর্থ হচ্ছে ব্যবসা করা। শব্দটি বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করলো অর্ধ তৎসম শব্দ হিসাবে। সেখান থেকে বৈশ্য- মানে ব্যবসা থেকে বাংলা ভাষায় ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে নতুন শব্দ হলো ‘‘বেশ্যা’’ আর যার অর্থ হলো টাকার বিনিময়ে যে দেহব্যবসা করে সেইই বেশ্যা। শব্দটির কপাল মন্দ হওয়ায় মুল সংস্কৃত ভাষা থেকে ছিটকে বাংলা মুল্লুকে এসে কতইনা লাঞ্চনা-গঞ্জনার শিকারে পরিণত হলো। তার হিসাব কে রাখে। তার জন্য লেখকের অফুরন্ত সহানুভূতি।

১৪. গাঁজা: গাঁজা শব্দটি তিনটি জায়গায় তিনভাবে বসে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। এই গাঁজা যখন রাজ দরবারে রাজা বাদশা ও কবি সাহিত্যিকরা সেবন করে তখন গাঁজার নাম পরিবর্তন হয়ে নাম হয় গঞ্জিকা। এরপর সাধু সন্যাসীর আশ্রমে যখন গোসাইরা সেবন করে তখন এটার নাম হয় সিদ্ধি। আর সমাজের নিম্নশ্রেণির লোকজনেরা যখন এটা সেবন করে তখন সেটা হয় গাঁজা। কাউকে গাঁজাখোর বললে যে রিয়াক্ট পাওয়া যায় সিদ্ধিখোর কিংবা গঞ্জিকাখোর বললে তার কোনো রিয়াকশন নাই।

১৫. প্রতিশব্দের ছড়াছড়ি: বাংলা ভাষায় একটি শব্দের একাধিক সমার্থক শব্দ রয়েছে যা কিনা অন্য ভাষায় বিরল। কেবলমাত্র সূর্য শব্দের রয়েছে ২৯টি প্রতিশব্দ। সূর্য, সূর্যি, সূরুজ, দিবাকর, প্রভাকর, ভাস্কর, রবি, সবিতা, ভানু, তপন, অর্ক, মিহির, অরুন, আদিত্য, অংশুমালী, দিনমনি, মার্তণ্ড, বেলা, দিনপতি, দিননাথ, বিভাবসু, উষাপতি, বিভাকর, দিনেশ, চিত্রভানু, দিনকর, পুষন, কিরনমালি ও দিনকর। যা পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

১৬. লিঙ্গের আজাইরা প্যাচাল: আইন কোন লিঙ্গ? রসিকজনেরা উত্তর দিয়েছেন ঠিক ভাবেই।আর তা হলো আইন হচ্ছে স্ত্রী লিঙ্গ।কারন আইনের অনেক ফাঁক ফোঁকর আছে।অপর দিকে কাঠালকে পুং লিঙ্গ বলা হয়েছে কারণ কাঠালের বিচি আছে। কোল বালিশ নিয়ে নর-নারী সবাই যে পায় সেই তো দু পায়ের মধ্য দিয়ে পিষ মারে। ফলে কোল বালিশ উভয় লিঙ্গ। শিক্ষক এর স্ত্রীকে শিক্ষয়িত্রী বলে কিন্তু অধ্যক্ষ সারের স্ত্রীকে কি বলে তার কোনো স্পষ্ট জবাব বাংলা ভাষায় মেলে নাই।

১৭. বাংলা কি খুব কঠিন ভাষা: বাংলা ভাষায় মোট অক্ষর আছে ৫০টি। তার মধ্যে ১১টি স্বর বর্ণ আর ৩৯টি ব্যঞ্জন বর্ণ। অক্ষর গুলিও দারুন জটিল। ঐ শব্দটা লিখতে কলমের তিনটা মোচর দিতে হয়। আর ঈ লিখতে দিতে হয় ৪টি আর ক্ষ এবং ক্ষ্ম লিখতেতো কলমের অবস্থা ত্রাহিত্রাহি । আচ্ছা এতগুলো স দেওয়ার কারন কি ছিল। দন্ত স,মূর্ধন্য ষ আর তালব্য শ। আবার ন এবং ণ দিয়ে এবং ঈ ই ঊ উ বর্নমালা দিয়ে দারুণ এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি joint secretary বাংলা করলে দাঁড়ায় যুগ্ম সাধারন সম্পাদক। ইংরেজিতে ২ শব্দ আর বাংলায় হচ্ছে ৩ শব্দ। এখানে যুগ্ম ও সাধারণ সম্পাদক সমাসবদ্ধ হওয়ায় লিখতে হবে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক। কিন্ত এখানে কি তা লিখা হয়? লেখা হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যুক্ত অক্ষর এর মত একটা জটিল পদ্ধতি কেন যে ভাষা সৃষ্টি কারীরা করেছিলেন। তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না।

কৃতজ্ঞতা: বাল্য বন্ধু অস্টক গানের মাস্টার শিরগ্রামের কৃষক ছত্তার মোল্লা ও স্কুল জীবনের ব্যকরণের স্যার ননীগোপাল সরকার।

লেখক: বিশ্লেষক, কলামিস্ট, আইনজীবী, মাগুরা বার

আমারসংবাদ/জেডআই