সাদ্দাম হোসাইন
নভেম্বর ২০, ২০১৮, ০৬:৩৫ এএম
পরিবারের বড় ছেলে অনিক।পরিবারে একমাত্র মা-ই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন। মা বুঝি এমনটাই হয়ে থাকে।তাই না? হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন সব নারীর হয়ত পূরণ করা হয় না। তবে সন্তানের সফলতার মধ্য দিয়ে মা খুঁজে পায় আত্মতৃপ্তি। অনিকের মা স্বপ্ন দেখতেন আমার ছেলে একদিন বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবে। ভালো চাকরি করবে, পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না মায়ের। অষ্টম শ্রেনী পর্যন্তই পড়াশোনার ইতি ঘটে অনিকের জীবনে। পরে বেশ কিছু দিন ঘুরাঘুরি। মা চিন্তায় পড়ে গেলেন এই ভাবে তো আর জীবন চলবে না। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে সংসারের বড় ছেলে হিসেবে তার উপর বড় ধরনের দায়িত্ব ন্যাস্ত হচ্ছে। এদিকে অনিকের বয়স ২০ পেড়িয়ে ২১ পা রেখেছে। ৩ বোন, পাঁচ ভাই আর মা-বাবা কে নিয়ে তাদের পরিবার। কোনো চাকরিজীবী ছিল না তাদের পরিবারের মধ্যে। তবে তাদের গ্রামে জমি ছিল। প্রতি বছর তাদের সংসারের জন্য চাউল বরাদ্দ রেখে বাকীগুলো বিক্রি করে তাদের বাড়তি আয় হয়ত। বাবা তাদের নিজের জমিতে শীতকালিন সবজিসহ অনেক কিছুই চাষ করতেন। পরিবারের আয়ের মধ্যে এগুলো ছিল তাদের আয়ের উৎস। পরিবারের কষ্ট দেখে অনিকের আর সহ্য হচ্ছিল না। বাবা-মাকে বলল সে বিদেশ যাবে।বাব-মাও রাজি হলো। পাসপোর্ট করার জন্য অনিকের ১০ হাজার টাকা জরুরী প্রয়োজন। এই মুহূর্তে কারো কাছে টাকা নাই। পাসপোর্ট করার জন্য টাকা পাচ্ছে না। অনিকের বড় বোন গোপনে তার অলঙ্কারগুলো বন্ধক রেখে ২০ হাজার টাকা এনে অনিককে পাসপোর্ট করতে দেয়। অবশেষে সৌদি আরবে পাড়ি জমান অনিক। বিদেশ গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করতেন অনিক। কিছু দিন চলে যাওয়ার পর অন্যেদের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায় অনিকের প্রবাস জীবন। এই ভাবেই চলছে অনিকের প্রবাস জীবন। প্রায় ৫ বছর প্রবাস জীবন কাটানোর পর অনিক ছুটিতে বাংলাদেশে আসে। মা সিদ্ধান্ত নিল অনিককে বিয়ে করাবে। অনিককে বিয়ের বিষয়ে বললে প্রথমে রাজি না হলেও পরে মায়ের সিদ্ধান্তে একমত হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, সব সন্তানদের মধ্য থেকে বড় ছেলেদেরকে না কি পিতা-মাতা একটু বেশি আদর করেন, বাস্তবে আসলেই কি তাই? হ্যাঁ। একদম চিরন্তন সত্য কথা। প্রতিটা পরিবারের প্রথম সন্তানকে তার মা-বাবা একটু বেশিই ভালোবাসে। দেশে আসার পর হবু বউ দেখে অনিক কোনো রকম আপত্তি করেনি বিয়েতে। তাই অনিকের বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত সেই দিনে অনিক বিয়ে করল। নতুন বউ! গ্রামের ছেলেদের বিয়ের একটা ঐতিহ্য আছে, সেটা হচ্ছে যখন ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে আসে তখন নতুন বউকে স্বাগত জানায়। বিয়ে বাড়িতে থাকা ছোট ছেলে-মেয়েরা আঞ্চলিক ভাষায় এই স্লোগান দেয়, বউ আইছেরে; বউ আইছে! (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষা) এই বলে নতুন জামাই-বউয়ের গাড়ির সামনে কিন্তু অনেকটা ভীড়ও লক্ষ্য করা যায়।বিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ! কবি বলেছেন, সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আসলেও তাই। আনন্দের সময় কিভাবে যে কেটে গেল কিঞ্চিত পরিমাণ অনুভব করতে পারেনি অনিক। সময় হয়ে গেছে জীবিকার তাগিদের প্রবাসে ফিরে যাওয়ার। তাই জীবিকার তাগিদে সদ্য বিবাহিত প্রিয়তমাসহ সবাইকে ছেড়ে পাড়ি দিলেন প্রবাসে। অনিক প্রবাসে চলে যাওয়ার কিছুদিন অতিবাহিত হতে না হতেই তার স্ত্রীর মনমানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।যা পরিবারের জন্য খুবই দুঃখের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা পরিবারের একমাত্র উপার্জন ব্যক্তি ছিল অনিক। অনিকের স্ত্রী চাই সে, আলাদা হয়ে সংসার করবে! বিষয়টি অনিকের মা-বাবা জানতে পেরে তাদের পরিবারের সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে। মা তার প্রবাসী ছেলে অনিককে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অনিকের অভিযোগ উল্টো মা-বাবার বিরুদ্ধে। তার বিবাহিত স্ত্রী অনিকের পরিবারের সব সদস্যরা অসস্মানিত করে। বাবা বাড়িতে অনেক বেশি কথা বলে, যা তার ভাল লাগে না। সেই অনেক অভিযোগ উপস্থাপন করল মায়ের কাছে। এক পর্যায়ে মা তার আদরের সন্তানের সুখের জন্য, তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী আলাদা করে দেয় তাদেরকে। বেশ ভালই চলছে অনিকের সংসার। একদিন অনিকের মায়ের পায়ে ব্যাথা লাগে। পায়ের চিকিৎসা করাতে অনিকে কাছে কিছু টাকা চাই তার মা। কিন্তু পায়নি। এর দুইদিন পর স্ত্রীর সামান্য সমস্যার জন্য, চিকিৎসার টাকা পাঠায় অনিক। মা বিষয়টি জানতে পেরে চোখ বন্ধ করে শুধু কাদেঁ ছেলের সুখের জন্য। পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। কবির ভাষায়, যেখানে দেখি যাহা, মা-এর মতন আহা, একটি কথায় এত শুধা মেশা নাই। জগৎ সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্ত্বনা আর স্নেহ-ভালোবাসা আমাদের সব বেদনা দূর করে দেয়, তিনিই হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দুঃখে-কষ্টে, বিপদে-সংকটে যে মানুষটি স্নেহর পরশ বিছিয়ে দেন, তিনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন, মা। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা একমাত্র মায়ের। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক, যা একটু আঘাত পেলেই প্রতিটি মানুষ মা বলে চিৎকার দিয়ে জানান দিয়ে থাকে।সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে মা-ই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। গর্ভধারণ, দুধপান, রাত জেগে সন্তানের তত্ত্বাবধানসহ নানাবিধ কষ্ট একমাত্র মা-ই সহ্য করেন। তাছাড়া সন্তানের প্রতি মা-ই সবচেয়ে বেশি যত্নবান ও বেশি আদর-সোহাগ করে থাকেন। অনিকের স্ত্রী আর তার মতো যেন পৃথিবীর কোনো মায়ের সন্তান এমন আচরণের শিকার না হয়। ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে রাখা মাসহ বাবার শেষ বয়সে যেন সেবায় নিয়োজিত হতে পারে সেই আশায় করছি। আসুন এখন প্রতিজ্ঞা করি, আর যেন কোনো মা এই ভাবে দুই চোখের পানি কোন সন্তানের অবহেলার শিকার না হয়।