প্রিন্ট সংস্করণ॥জিয়া উল ইসলাম
ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯, ০৪:০৪ এএম
সারা দুনিয়ায় আধুনিক দেশ, নগর, সভ্যতা, বিপ্লব, সংগ্রাম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইতিহাসে সংবাদপত্রের ভূমিকা রয়েছে অনেক। সংবাদপত্র বা খবরের কাগজ হলো একটি লিখিত প্রকাশনা যার মধ্যে থাকে বর্তমান ঘটনা, তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, বিভিন্ন ফিচার এবং বিজ্ঞাপন। এটি সাধারণত স্বল্প-মূল্যের কাগজে মুদ্রণ করা হয়। সংবাদপত্র ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন রোমে, অ্যাক্টা দিউরমা বা সরকারের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হতো। সেটা ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনসমাগম হয়, এমন জায়গায় টাঙিয়ে দেয়া হতো। ৮ম শতাব্দীর দিকে চায়নায় কাইয়ুয়ান ঝা বাও নামে এক রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয় মুসলমান রাজত্বকালে। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হতো না, সমস্ত রাজনৈতিকবিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হতো এবং তা দেশের রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হতো। বিভিন্ন প্রদেশের সব সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল। কৌটিল্যের তথ্য অনুযায়ী মৌর্য শাসনকালে এক শ্রেণির কর্মচারীর কাজ ছিল রাজ্যের যাবতীয় খবর রাজদরবারে পেশ করা। মুগল আমলে প্রচলিত নিউজলেটার, রাজকীয় বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য লিখিত যোগাযোগের কথাও ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করে থাকেন। তবে আধুনিক অর্থে উপমহাদেশে সংবাদপত্র ১৭৮০ খ্রিব্দের ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় প্রথম চালু হয়। বেঙ্গল গেজেট বা হিকির বেঙ্গল গেজেট নামে এটি ছিল ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকা ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। এটি দুই বছর পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছিল। ১২ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৮ ইঞ্চি প্রস্থ দুই পৃষ্ঠার এ পত্রিকাটির মালিক, সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ২৩ মার্চ ১৭৮২ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হযে যায়।উপমহাদেশে বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র হলো দিগদর্শন। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রথম এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। চার পৃষ্ঠার পত্রিকাটি ছিল বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক পত্রিকা। এখানে বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ একসঙ্গে প্রকাশিত হতো। শ্রীরামপুরের সাংবাদিকরা একটি নিজস্ব ভাষারীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি ছিল মাসিক পত্রিকা এবং এখানে ছাত্রদের উপযোগী ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা রচনা থাকত। একই বছরের মে মাসে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা আরেকটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করে। এটি ছিল জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। এটি প্রায় ২০ বছর চালু ছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দেই বাঙালি মালিকানায় প্রথম সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশিত হয়, প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য। কারো কারো মতে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য। মাঝে মধ্যে এতে ইংরেজি ও হিন্দিতে কিছু নিবন্ধ মুদ্রিত হলেও সাধারণভাবে এর ভাষা ছিল বাংলা। হরচন্দ্র রায় ছিলেন বাঙ্গাল গেজেটটির সম্পাদনাকার্যে গঙ্গাকিশোরের অন্যতম সহযোগী। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে জেমস সিল্ক বাকিংহাম সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল অর্ধ-সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক-এ রূপান্তরিত হয়। ক্যালকাটা জার্নালই ছিল উপমহাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। ১৭৮০-১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সংবাদপত্রগুলো মূলত কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং শিল্প-সাহিত্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত। উপহাদেশের বাংলাদেশ অঞ্চলে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা শহর রংপুর থেকে প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র রংপুর বার্তাবহ প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুন্ডির জমিদার কালীচরণ রায় চৌধুরী। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিকের নাম ছিল ঢাকা নিউজ, এটি সম্পাদনা করতেন এ.আর ফোর্বস। ১৮৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ থেকে অন্তত চারটি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল রংপুর দিকপ্রকাশ, কবিতা কুসুমাবলী (ঢাকা), মনপঞ্জিকা (ঢাকা) এবং পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মোট ৩৮টি সংবাদপত্র ছিল, যার মধ্যে ১০টি প্রকাশিত হতো পূর্ববঙ্গ থেকে। এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু, ঢাকা প্রকাশ, মহাপাপ এবং বাল্যবিবাহ (ঢাকা থেকে); গ্রাম দূত, বালারঞ্জিকা, হিতসন্ধানী, বরিশাল বার্তা (বরিশাল থেকে), হিন্দু রঞ্জিকা (রাজশাহী) এবং রংপুর দিকপ্রকাশ (রংপুর)। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে যশোর থেকে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত অমৃতবাজার পত্রিকা যেটি এ অঞ্চলে ম্যালেরিযা আবির্ভাবের কারণে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় উঁচুমানের ইংরেজি অর্ধ-সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট দশটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। এ সময়ে অধিকাংশ পত্রিকাই পরিচালিত হতো হিন্দু মালিকানায়। ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় গরণ ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তৎপরতার বছরগুলোতে বাংলাদেশ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের ভিত্তি প্রশস্ত হয়। এ সময় বাংলা থেকে প্রকাশিত ১৭৩টি সংবাদপত্রের মধ্যে আনুমানিক ৬৫টি পূর্ববঙ্গ থেকে মুদ্রিত হয়। এদের অধিকাংশই ছিল মতামতধর্মী, যেগুলোর উপজীব্য ছিল সাহিত্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা, সংস্কার এবং ধর্ম। পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত জ্যোতি। এর প্রকাশ শুরু হয় ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট। এরপর ১৯২৯-এ চালু হয় দৈনিক, ১৯৩০-এ দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা, ১৯৩৬-এ দৈনিক আযান এবং ১৯৪৬-এ দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-৭০) শুরুর দিকেও পূর্ববঙ্গের সংবাদপত্র শিল্প কেবল মিশনারি পর্যায় অতিক্রম করছিল। ভারত বিভক্তির সময় আব্দুস সামাদ সম্পাদিত দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান-ই কেবল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো। বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারত গমনের ফলে পূর্ববঙ্গে গুরুতর শূন্যতার সৃষ্টি হয় যা সংবাদপত্র শিল্পের জন্য ছিল ক্ষতিকর। ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলায় প্রথম যে দৈনিকের আবির্ভাব ঘটে তার নাম ছিল পয়গাম (সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী)। এটি ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশনা শুরু করে জিন্দেগী নামক অর্ধ-সাপ্তাহিক। মওলানা আকরম খাঁর কলকাতাভিত্তিক দৈনিক আজাদ-ও ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৪৮ সাল থেকে প্রকাশনা শুরু করে। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় প্রকাশিত হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার। আরও দুটি সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ যথাক্রমে ১৯৪৯ ও ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এগুলো এখনো বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে আছে। পরবর্তী প্রকাশনাগুলোর মধ্যে ছিল দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), পূর্বদেশ এবং দ্য মর্নিং নিউজ।এরপর প্রকাশিত হয় শাশ্বত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, বাংলার বাণী, বিপ্লবী বাংলা, দ্য নেশন, মুক্ত বাংলা, দ্য পিপল, দুর্জয় বাংলা, মুক্তি, একতা ইত্যাদি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০টি। ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিচিত্রার প্রকাশনা শুরু হয় দৈনিক বাংলা প্রকাশনী থেকে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদপত্রে নিয়োজিত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য আইন প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকারিভাবে প্রকাশিত চারটি পত্রিকা ছাড়া সরকার অন্যসব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। পত্রিকা চারটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস। ১৯৭৫ সালের পর থেকে পুরনো পত্রিকাগুলো একে একে আবার প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সংবাদপত্র ছিল নিয়ন্ত্রিত। ১৯৮৪ সালে যায় যায় দিন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন মতের রেকর্ড সংখ্যক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে সংবাদপত্রে রঙিন ছবি মুদ্রণও সুন্দর গেটআপে নতুন পত্রিকা চালু হয়। নব্বই দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ছিল ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ইনকিলাব, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকা, মুক্তকণ্ঠ, প্রথম আলো, সংবাদ, মানবজমিন, সংগ্রাম, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, দ্য ডেইলি স্টার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং নিউ নেশন। ২০০০-এর দশকে সংবাদপত্র জগতে উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন ছিল: যুগান্তর, সমকাল, যায়যায়দিন, আমারদেশ, নয়াদিগন্ত, কালেরকণ্ঠ, দি নিউজ টুডে, নিউ এজ ও আমাদের সময়। এরপর বাংলাদেশে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়Ñ বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় দৈনিক আমার সংবাদ। পত্রিকাটির শুরু থেকেই প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে আছেন তরুণ সাংবাদিক হাশেম রেজা। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিকসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত আজাদী ও পূর্বকোণ, বগুড়া থেকে করতোয়া, খুলনা থেকে পূর্বাঞ্চল এবং সিলেট থেকে যুগভেরী। স্বাধীনতার পর যে সব সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্যে বিচিত্রা ও যায় যায় দিন ছাড়া উল্লেখযোগ্য হলো হলিডে, রোববার, সচিত্র সন্ধানী, পূর্ণিমা, ঢাকা কুরিয়ার, খবরের কাগজ, আগামী, সাপ্তাহিক ২০০০, সাপ্তাহিক এখন, সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, শীর্ষকাগজ ও শৈলী। মহিলা পাঠকের জন্য পাকিস্তান আমল থেকে প্রকাশিত বেগম-এর অনুপ্রেরণায় ১৯৮৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে পাক্ষিক অনন্যা। আর এভাবে উপমহাদেশে ধারবাহিকভাবে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়ে আসছে।